২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভৈরববাসী আজো কাঁদে আইভি রহমানের জন্য

-

আইভি রহমান। পুরো নাম জেবুন্নাহার আইভি। ২১ আগস্টে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিন দিন মৃত্যুর সাথে লড়ে ২৪ আগস্ট এই নেতা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তার চিরপ্রস্থানে জন্মস্থান ভৈরবের মানুষ হারায় তার একান্ত সুহৃদ, প্রিয় আইভি আপাকে। পৈশাচিক গ্রেনেড হামলায় প্রিয় আইভি আপার গুরুতর আহত হওয়ার খবর পৌঁছার সাথে সাথে প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পুরো ভৈরব।
ওই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক মো: রফিকুল ইসলাম জানান, ২২ আগস্ট দিনটি ভৈরববাসীর জন্য এক কালো দিন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান আহতসহ হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে ২২ আগস্ট ভৈরবে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এ হরতাল আহ্বান করে। হরতালের সমর্থনে ভোর থেকে নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজার আওয়ামী লীগ অফিসে জড়ো হয়। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনটি ভৈরব বাজার রেলজংশনের মনমরা রেলসেতুর কাছে পিকেটারদের কবলে পড়ে। উত্তেজিত জনতা ট্রেনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম বলেন, সর্বদা পরিশ্রমী, অক্লান্ত ছুটে চলা আইভি রহমান আজ স্মৃতির সাদা ফ্রেমে বাঁধা নিশ্চুপ ছবি হলেও, ভৈরববাসী আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে তিনি জীবন্ত, চলমান। তিনি বেঁচে আছেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ তাকে ভোলেনি। ভৈরববাসী আজো কাঁদে আইভি রহমানের জন্য।
ভৈরব মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক উলফাত আরা জাহান জানান, ১৯৯৬ সালে তিনি যখন ভৈরব মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন, আইভি রহমান তখন কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান। ভৈরবে এলেই তিনি ডাকতেন। কথা ও কাজে এক ছিলেন তিনি। দেশীয় খাবার খেতে পছন্দ করতেন তিনি। শুঁটকির ভর্তা ছিল তার প্রিয় খাবার। ১৯৯৮ সালে মহিলা সংস্থার অফিস নির্মাণ ছাড়াও মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তিনি ভৈরব বাজারে মহিলা সমবায় মার্কেটের জন্য জায়গা বরাদ্দের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উলফাত আরা জাহান বলেন, নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার এমন মানুষ আর দেখা যায় না। গ্রেনেড হামলার ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগেও তিনি ভৈরবে এসেছিলেন।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উলফাত আরা জাহান বলেন, ওই বছর ভৈরবে বন্যা হয়েছিল। নিজ এলাকার দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে জলাবদ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়ি বাড়ি ছুটে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ত্রাণসামগ্রী। জন্মস্থান ভৈরবে তিনি আজীবন এভাবে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ও জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে এখানকার নারীদের উন্নয়ন এবং সমাজের অবহেলিত শিশু, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে তিনি ব্যাপক কাজ করেন। সেসব অসহায় মানুষের কাছে আইভি রহমান এখনো দেবীতুল্য। উলফাত আরা জাহান জানান, একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন করতেন আইভি রহমান। পরতেন সুতির শাড়ি। আমৃত্যু মানুষকে ভালোবেসে গেছেন, তাদের ভালোবাসা পেয়েছেন। মানুষকে অকাতরে দান করলেও সেসব প্রচার করতেন না তিনি। তার মতো এমন মানবদরদি খুবই বিরল।
১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব শহরের চণ্ডিবের গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে আইভি রহমানের জন্ম। বাবা মরহুম জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। মা হাসিনা বেগম ছিলেন আর্দশ গৃহিণী। আট বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আইভি ছিলেন পঞ্চম। ছেলেবেলা থেকেই আইভি ছিলেন শান্ত স্বভাবের, তবে প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্না। তার ব্যক্তিত্ব ও গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বভাবের জন্য তাকে বাইরে থেকে খুব কঠিন মনে হলেও আদতে তিনি ছিলেন খুবই দরদি মনের মানুষ। যারা মিশেছে, কাছে গেছে তারাই পেয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা, আদর, মমতা আর সহযোগিতা।
প্রথম দর্শনেই আইভিকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম পুরুষ মরহুম প্রেসিডেন্ট মো: জিল্লুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে নবম শ্রেণীপড়–য়া আইভির সাথে ১৯৫৮ সালের ২৭ জুন মরহুম প্রেসিডেন্ট মো: জিল্লুর রহমানের বিয়ে হলে নামের পরে ‘রহমান’ যুক্ত হয়। এ নামেই তিনি পরিচিতি পান দেশব্যাপী। শুধু আওয়ামী রাজনীতির জন্য নয়, আইভি রহমান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে পারিবারিকভাবেও জড়িত ছিলেন। তার বড় বোন শামসুন্নাহার সিদ্দিক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার শাশুড়ি। একমাত্র ছেলে বিসিবি সভাপতি ও সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন, দুই মেয়ে তানিয়া বাখত ও তনিমা রহমান ময়না এবং তাদের ছেলেমেয়ে ও স্বামী জিল্লুর রহমানকে নিয়ে তার পারিবারিক জীবন ছিল খুবই গোছানো। গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে আইভি রহমানের মৃত্যুর পর তাই বিষাদভরা কণ্ঠে মো: জিল্লুর রহমান জানিয়েছিলেন, ‘আইভিকে ছাড়া আমি জীবন্মৃত।’ ভৈরবের বাড়ির ‘গৃহকোণ’ নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘আইভি ভবন’। এই বাড়িটিতে ভৈরববাসীর সাথে আইভি রহমানের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আইভির রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য জীবনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একই সাথে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে আইভি রহমান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ভারতে গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে জাতীয় মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী হন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আইভি রহমান চলে গেছেন ১৪ বছর হলো। কিন্তু ভৈরবে ‘আইভি ভবন’ আছে আগের মতোই। সেখানে বিভিন্ন উপলক্ষে এসে অশ্রুপুষ্পে ভৈরববাসী স্মরণ করেন তাদের প্রিয় নেত্রী আইভি রহমানকে। বাংলার এই কৃতী সন্তানের স্মরণে ভৈরবের কমলপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নির্মাণ করা হয়েছে ‘আইভি রহমান গেইট’। চণ্ডিবের গ্রামের নিজ বাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। ভৈরব জিল্লুর রহমান সরকারি মহিলা কলেজের একটি ছাত্রীনিবাসের নামকরণও করা হয়েছে তার নামে।


আরো সংবাদ



premium cement