২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দক্ষিণডিহির দ্বিতল বাড়ি নজর কাড়ে

অনন্য স্থাপত্য
-

খুলনার ফুলতলা উপজেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে তিন কিলোমিটার দূরত্বে দক্ষিণডিহি গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি আবার যশোর জেলার সীমানা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। পথের দুই পাশ তরুসার ও ছায়াময়। ফাঁকে ফাঁকে নয়নমনোহর গ্রামীণ দৃশ্যপট। সবুজ ধানক্ষেত। মাঝে মধ্যে পানের বরজ। পাখিদের কলকাকলি। এ গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে হাঁটলেই দূর থেকে চোখে পড়বে দ্বিতল একটি বাড়ি। ব্রিটিশ ঘরানার বাড়িটির আভিজাত্য ও পরিপাট্য নজর না কেড়ে পারে না। বাড়িটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি।
কালের পরিক্রমায় একসময় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও বর্তমানে বাড়িটি ফিরে পেয়েছে তার উজ্জ্বলতা। পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে ১৯৯৫ সালে খুলনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাড়িটি উদ্ধার করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৯ নভেম্বর বাড়িটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এটি এখন ‘দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
তবে জেলা প্রশাসনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমপ্লেক্সের ৩ দশমিক ৭৩ একর জমির ওপর অনেকটা ভারতের শান্তিনিকেতনের আদলে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স গড়ার একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছর ২৫ বৈশাখ ও ২২ শ্রাবণে বরীন্দ্রজয়ন্তী ও কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে তিন দিনব্যাপী আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ লোকমেলার উৎসব বসে।
রবিঠাকুরের লেখনী, কর্মকাণ্ড ও তার জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে ও হচ্ছে। তাকে নিয়ে গবেষণাও কম হচ্ছে না। নিত্যনতুনভাবে উন্মোচিত হচ্ছেন তিনি। কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির বিষয়ে খুব বেশি তথ্য বা লেখা পাওয়া যায় না। অথচ শ্বশুরবাড়ি নিয়ে তার অনেক স্মৃতি, অনেক মুগ্ধতা, অনেক নস্টালজিয়া থাকার কথা। জানা যায়, রবিঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি যে গ্র্রামে, খুলনার ফুলতলা উপজেলার সেই দক্ষিণডিহি গ্রামটি তার মাতুল বাড়িও।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সাথে দক্ষিণডিহির সম্পর্ক নিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই দক্ষিণডিহি গ্রামে। রবীন্দ্রনাথের কাকী ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী এ গ্রামেরই মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী দক্ষিণডিহিরই মেয়ে। ২২ বছর বয়সে কবির বিয়ে হয় দক্ষিণডিহি গ্রামের বেণীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ভবতারিণী ওরফে মৃণালিনী দেবীর সাথে। যৌবনে কবি কয়েকবার তার মায়ের সাথে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামার বাড়িতে এলেও শ্বশুরবাড়ি এসেছেন কি না জানা যায়নি। তবে বিয়ের আগে পাত্রী দেখার সুবাদে একবার ঘুরে গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। তবে তার পূর্বপুরুষেরা খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।
আরেকটি সূত্রে জানা যায়, খুলনার প্রথম বিদ্যালয় সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি হীরালাল সেন রচিত এবং বিশ্বকবিকে উৎসর্গকৃত বিদ্রোহী কাব্যগ্রন্থ হুঙ্কার লেখার দায়ে ব্রিটিশদের করা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার সাক্ষ্য দিতে তাকে ১৯০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর খুলনা মহকুমার আদালতে হাজিরা দিতে হয়। সেই সুবাদে তিনি শ্বশুরবাড়িতে নাকি বেড়াতে আসেন।
বেণীমাধব রায় চৌধুরী ছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর এস্টেটের সেরেস্তাদার। তার স্ত্রী দাক্ষায়ণী দেবী। তাদের একমাত্র মেয়ে ভবতারিণীর জন্ম সম্ভবত ১৮৭৪ সালের ১ মার্চে। ফুলি নামেই কাছের মানুষদের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। জোড়াসাঁকো পরিবারের প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দক্ষিণদিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ে সারদা সুন্দরী দেবীকে বিয়ে করেন। উভয় পরিবারই ছিলেন পিরালি বংশোদ্ভূত। এ দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সারদা সুন্দরী দেবীর পিসি আদ্যাসুন্দরীর ঘটকালিতে ভবতারিণীকে বিয়ে করেন রবিঠাকুর। ভবতারিণীর বয়স তখন মাত্র ১০ আর রবীন্দ্রনাথের ২২ বছর। ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বিয়ে উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বর সেজে দক্ষিণডিহিতে আসেননি, কনেকে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। এটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী একটি ঘটনা। বিয়েতে কোনো আড়ম্বর ছিল না। এমনকি নিজের পৈতৃক নামটিও হারিয়ে ফেলতে হয় ভবতারিণীকে। বিয়ের পর স্বামী তার নামকরণ করেন মৃণালিনী।
বিয়ের পরই একবার নিজ বাড়ি দক্ষিণডিহিতে এসেছিলেন ভবতারিণী। এরপর আর আসতে পারেননি। কবিগুরুর শ্যালক নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ওই বাড়ির দ্বিতল ভবনসহ ৮ দশমিক ৪১ একর জমির মালিক ছিলেন। তার দুই ছেলে বীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ও ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ৭ দশমিক শূন্য ৮ একর জমির স্বত্বাধিকারী হন। তাদের মৃত্যুর পর এবং উত্তরাধিকারীদের অনুপস্থিতির কারণে তা অবৈধ দখলে চলে যায়। পরে দ্বিতল ভবনসহ এ জমি সরকারের অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। ভবতারিণীর পরিবার অনেক আগেই কলকাতা চলে গেলেও সেখান থেকেই সম্পত্তির দেখভাল করা হতো। কিন্তু দেশভাগের পর এ সম্পত্তি আস্তে আস্তে বেদখল হতে থাকে। তার পরও ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ক্ষীণ হলেও তাদের একটি যোগাযোগ ছিল। ক্রমেই তা চলে যায় দখলদারদের কবজায়। একপর্যায়ে এটি হয়ে পড়ে ঠিকানাবিহীন।
বর্তমানে ভবনটির অবকাঠামো ছাড়া অবয়ব আগের মতো নেই। খোলনলচে খানিকটা বদলে ফেলা হয়েছে। সংযোজিত হয়েছে বেশ কিছু ফটোগ্রাফ। বেড়েছে সীমানা। সেই সাথে নতুন সীমানা প্রাচীর। দ্বিতল ভবনের সামনে রয়েছে বিশ্বকবি ও মৃণালিনী দেবীর আবক্ষ মূর্তি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রয়েছে মৃণালিনী মঞ্চ। মঞ্চের বেশ দূরে একটি ভবনে স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র। সাহিত্যিক প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, দক্ষিণডিহি খুলনাবাসীর অনেক বড় গর্বের স্থান। প্রতি বছর এখানের লোকমেলা পরিণত হয় দেশী-বিদেশী গুণীজনদের মিলনমেলায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যত দিন থাকবে, কবিগুরু ও তার দর্শন তত দিন অমর হয়ে থাকবে। আমাদের উচিত, এটিকে ঘিরে যে প্রাণের সঞ্চার হয় সেটিকে সামগ্রিক রূপ দেয়া। তা হলেই তার স্মৃতি যথাযথ মর্যাদা পাবে।


আরো সংবাদ



premium cement
পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে: পাটমন্ত্রী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও নেতাকর্মীরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে : সালাম নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে কাজ করছে সরকার : পরিবেশ সচিব সৌরশক্তি খাতে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় জার্মানি ‘সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই বিচার প্রক্রিয়ার ধীর গতি’ মোদি কি হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের চেনা রাজনীতিতে ফিরছেন? টাঙ্গাইলে বৃষ্টির জন্য ইসতেসকার নামাজ ফুলগাজীতে ছাদ থেকে পড়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু দোয়ারাবাজারে শিশু হত্যা মামলার আসামিসহ গ্রেফতার ২ কাউখালীতে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু চুয়েট শিক্ষার্থীদের সড়কে অবস্থান অব্যাহত, ঘাতক বাসচালক গ্রেফতার

সকল