২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সর্পবিশারদ অলি মিয়ার দাবি : ডিসি সাহেব বললেন সাবাস

সর্পবিশারদ অলি মিয়ার দাবি : ডিসি সাহেব বললেন সাবাস - নয়া দিগন্ত

সাভারের পোড়াবাড়ির সর্প বিশারদ অলি মিয়ার দাবি- তার চিকিৎসায় ভালো হয়েছে সাপে কাটা অসংখ্য রোগী। সেই সাথে এ কথাও স্বীকার করেছেন, চিকিৎসা দিয়েও বাঁচাতে পারেননি অনেককে। অলি মিয়ার গর্বভরে বলেন, গাজীপুর সদর থানার রথখোলা এলাকায় সাপে কাটা এক রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ভালো করার কাহিনী। এজন্য ওই সময়ের গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) তাকে বাহবা দিয়েছিলেন। দেশের অনেক এলাকায় চিকিৎসা দিয়ে বেশ নাম আর যশ খ্যাতিও কামানোর কথাও তিনি জানান। আবার দিনাজপুরের আট বছরের এক শিশুকন্যাকে চিকিৎসা দিয়েও তিনি বাঁচাতে পারেননি, দুঃখভরে সে কথাও জানান তিনি।

তবে সাপুড়ে দ্বারা সাপের বিষ নামানো বা চিকিৎসা পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও ধোঁকাবাজির সাথে তুলনা করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। বরং সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় সাপের বিষ থেকেই প্রতিষেধক তৈরিতে দেশে প্রথমবারের মতো আলাদা গবেষণা কেন্দ্র খোলা হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক ব্যাধি কর্মসূচি বিভাগ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এর ফলে সাপে কাটা রোগীদের কম খরচে সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে। দেশের চিকিৎসার গবষেণায়ও খুলছে নতুন দুয়ার।
সাপে কাটা রোগীদের কার্যকর চিকিৎসা দিতে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে কলেজে স্থাপন করা হয়েছে দেশের প্রথম অ্যান্টিভনেম গবষেণা কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক অনিরুদ্ধ বোষ। নয়া দিগন্তকে তিনি জানান, সাপুড়ে দ্বারা সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দেয়ার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তিই নেই। আর যেই চিকিৎসা পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই সেই চিকিৎসায় রোগী ভালো হওয়ার কোনো কারণও নেই।

যদিও দীর্ঘকাল থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে ওঝা বা সাপুড়েরাই। রোগীও ভালো হচ্ছে বলেও দাবি করা হয়ে থাকে। এটা কী করে সম্ভব? মনোবিজ্ঞানীদের মতে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে সব সাপ কামড়ায় সেগুলোর বেশির ভাগই বিষধর নয়। আবার গ্রামের কিছু মানুষের মনে দীর্ঘ দিনের কুসংস্কার বাসা বেঁধে থাকে। সাপে বা অন্য কোনো পোকামাকড় কামড় দিলেও ওঝা বা সাপুড়ে এসে বিষ নামানোর একটি প্রক্রিয়া শুরু করলেই ওই রোগী ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা বলেন, ওঝাদের বিষ নামানো অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার।
তবে অলি মিয়া তার দাবিতে অটল। তিনি তার চিকিৎসার সফলতার গল্প বলতে গিয়ে নয়া দিগন্তের এ প্রতিবেদককে জানান, বেশ কয়েক বছর আগে গাজীপুরের রাজবাড়ির কাছে রথখোলা এলাকায় ভোরে এক কৃষককে গোয়ালঘর থেকে সাপে কাপড় দেয়। বাড়ির লোকজন প্রথমে সাভারে তাদের এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে ফোনে খবর জানায়। সকাল ৯টায় আমি সেখানে পৌঁছি। বহু লোকের সমাগম হয় সেখানে। আমি সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়ে ওই রোগীকে সুস্থ করে তুলি। পরে সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন ওই সময়ের ডিসি ধিরাজ মালাকার। তিনি এসে দেখেন রোগী বসে আছেন। চার দিকে বহু লোক ভিড় করে ঘিরে আছে। ডিসি সাহেব চেয়ারে বসে জানতে চান এখানে কে চিকিৎসা দিয়েছে? ওঝা সাহেব কোথায়? আমি ডিসি সাহেবের পাশেই ছিলাম। তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে পিঠে হাত দিয়ে বললেন ‘সাবাস’। এভাবে অনেক এলাকাতেই আমি বাহবা পেয়েছি।

শুধু সফলতাই নয়, চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কথাও স্বীকার করলেন অলি মিয়া। দিনাজপুরের এক শিশুকন্যাকে চিকিৎসা দিয়েও তিনি বাঁচাতে পারেননি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল সেই মেয়ে। মাত্র আট বছর বয়স ছিল তার। বাড়ির কাছেই পুকুরের পাশে খেলতে গেলে সাপে কাটে তাকে। আমি তখন দিনাজপুরের অন্য একটি এলাকায় ছিলাম। খবর পেয়ে আমি তখনি ওই বাড়িতে যাই। কিন্তু পায়ের বিষ ততক্ষণে মেয়েটির সারা শরীরকে নীল করে ফেলেছে। তারপরও আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পায়ে সাপে কাটলে সাথে সাথেই হাঁটুর নিচে বেঁধে দিতে হয়। পরিবারের লোকজন সঠিক পন্থায় সে কাজটি করতে পারেনি। আবার দূরত্ব আর পরিবহন সঙ্কটের কারণে আমারও ওই বাড়িতে পৌঁছতে কিছুটা দেরি হয়েছিল। মেয়েটিকে বাঁচাতে পারিনি। মারা যাওয়ার পর মেয়েটির মা-বাবা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল।

তবে অলি মিয়া কিন্তু যুগের সাথে তাল মেলাতে কম যাচ্ছেন না। ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ নিয়েও নিজের প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে চাররঙ্গা একটি ভিজিটিং কার্ড প্রতিবেদকের হাতে তুলে দেন তিনি। নিজেকে আরেক দফা স্বনামধ্য ওঝা ও কবিরাজ বলে পরিচয়ও দেন।
অলি মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, এখন আগের মতো আমাদের কদর নেই। ঝাড়ফুঁকেও মানুষ আর বিশ্বাস করে না। তাই বেদে পরিবারগুলোর প্রধান আয়ের উৎসই হলো সাপের খেলা দেখানো। শহর এলাকায় আগের তুলনায় আমাদের মতো সর্প বিশারদদের কদর অনেক কমে গেছে বলেও জানান অলি মিয়া। তবে ঢাকার বাইরে গ্রাম এলাকায় এখনো অনেক মানুষ তাবিজের আস্থা রাখে, ঝাড়ফুঁকেও তাদের অনেক বিশ্বাস।
এ দিকে সরকারিভাবে সাপ ধরা ও সাপ ক্রয় বিক্রয় নিষিদ্ধ হলেও অলি মিয়া জানান, এখনো আমরা বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে সাপ ধরি। সরকার যদিও বন পাহাড় থেকে সাপ ধরা নিষিদ্ধ করেছে কিন্তু গৃহস্থের বাসা-বাড়িতে কিংবা গ্রামের কোনো বাড়িতে সাপ থাকলে সেই সাপ আমরা ছাড়া আর কেউ তো আর ধরার বা তাড়ানোর সাহস পাবে না। তাই লোকজনও বাধ্য হয়েই আমাদের ওপরই এখনো নির্ভর করেন। আমরা সাপ ধরে অন্য বেদেদের কাছে বিক্রি করি। তারা এই সাপ দিয়ে খেলা দেখায়।

অন্য দিকে সাভারের বেদে পল্লীর মধ্যপাড়ার আনোয়ার হোসেন নামের এক বেদে সর্দার জানান, বাংলাদেশে কাজ করেন এমন বিদেশীরা অনেক সময় আমাদের বেদে সর্দারদের সাথে যোগাযোগ করে নতুন ধরে আনা সাপ কিনে নিয়ে যান। তারা (বিদেশীরা) এ সাপ দিয়ে ওষুধ তৈরি করে বলে জানতে পেরেছি। কোন দেশের নাগরিকরা এই সাপ কিনতে আসেন জানতে চাইলে এই সর্দার বলেন, কোরিয়ান নাগরিকরাই বেশি যোগাযোগ করেন সাপ কিনতে।

গ্রামগঞ্জে সাপ খেলা দেখিয়েই পরিবারের জন্য আয় করেন নাটোরের সিংড়ার নইদার চাঁন। বয়স ২২-২৩ বছর হবে। এক সপ্তাহ আগে মা-বাবা, ভাই-ভাবীসহ ঢাকার সাভারের বাইপালে এসে মাচা তুলে বসতি গড়েছেন। তিনি জানান, এখন আর তাবিজ বিক্রি হয় না। পাড়া-মহল্লায় ঘুরে সাপ খেলা দেখিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। পরিবারের সবাই এ সাপ খেলা দেখান।
নইদার চাঁন আরো জানান, সাপ খেলা দেখিয়েও এখন ভালো আয় হয়। লোকজন সাপ খেলা দেখে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি টাকা-পয়সা দেয়। এ ছাড়া প্রতি মাসে বেদেদের নির্দিষ্ট একটি উৎসবের জন্যও আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল ও টাকা তুলি। তাবিজ-কবজ আর ঝাড়ফুঁকে আয় কমে গেলেও সাপ খেলা দেখিয়েই এখন বেদে পরিবারগুলোর সংসার চলছে বলেও জানান এই সাপুড়ে যুবক।


আরো সংবাদ



premium cement