২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফেনী নদী থেকে আরো বেশি পানি পাবে ভারত

ফেনী নদীর ওপারে ভারত, এপারে বাংলাদেশ। - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরে ফেনী নদীর উজানে ভারতকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের সম্মতি দেয়া নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আন্তঃসীমান্ত নদী হিসেবে ভবিষ্যতে এ নদী থেকে আরো বেশি পানি পাবে ভারত।

যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ভবিষ্যতে অভিন্ন সাতটি নদীর পানি বণ্টনের চুক্তির মধ্যে ফেনী নদীর পানির ভাগাভাগির বিষয়টিও আছে।

ফেনী নদীটি একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশের সরকারি তথ্যে ফেনী নদীর উৎপত্তি খাগড়াছড়িতে এবং এর দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটার। উৎপত্তির পর বাংলাদেশ ভারত সীমান্তরেখা বরাবর ভাটিতে এ নদী বঙ্গোপসাগরে এসে পতিত হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনে এ নদী সম্পর্কে যে তথ্য, তাতে এর দৈর্ঘ্য ১৪০ কিলোমিটার এবং দু’দেশের সীমান্তরেখায় এ নদী ৯৪ কিলোমিটার পর্যন্ত আর বাংলাদেশ অংশে ঢোকার পর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ৪৬ কিলোমিটার।

যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশের সদস্য কে এম আনোয়ার হোসেন বিবিসিকে বলেন, ‘ফেনী নদীর যে পানিবণ্টন চুক্তি সেটি এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে। এটার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই বাছাই হচ্ছে এবং খুব শিগগিরই ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন। সে সময় এই ১.৮২ কিউসেক পানি তাদের প্রাপ্য পানি থেকে সমন্বয় করা হবে। এটা জাস্ট মানবিক কারণে শহরে খাবার পানি সরবরাহের জন্য করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে যে পানিবণ্টন চুক্তি এটা আসলে এই চুক্তি নয়।’

ভারত বাংলাদেশ অভিন্ন সাতটি নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মধ্যে থাকবে ফেনী নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি। এর মানে ভবিষ্যতে এ নদীর থেকে আরো বেশি পানি পাবে ভারত।

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপো’র সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, ভারত ফেনী নদীর অর্ধেক পানি দাবি করেছিল। কিন্তু এ নদীর ৬০ ভাগ পানির অধিকার বাংলাদেশের বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এবার যে ফেনী নদীর পানি চুক্তি হলো এ প্রসঙ্গে যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকে সাবরুম শহরের মানুষের খাবার পানি সরবরাহের জন্য ১.৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের সিদ্ধান্ত ছিল। ২০১২ সালে কারিগরি কমিটির বৈঠকে সাতটি শর্তসাপেক্ষে খাবার পানি সরবরাহের জন্য ‘লো লিফ্ট’ পাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৯ সালের আগস্টে ঢাকায় সচিব পর্যায়ে বৈঠকে বাংলাদেশ এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ অক্টোবর ভারতে শীর্ষ বৈঠকে এ সমঝোতা স্মারক সই হয়।

পানি সরবরাহের শর্ত :
এবারের সমঝোতা অনুযায়ী ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি তুলবে ভারত, যার পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে ৫২ লিটার এবং দিনে প্রায় ৪৫ লাখ লিটার। সরকারিভাবে বলা হয়েছে মানবিক কারণে সাবরুমের পানি সংকট মেটাতে যে পানি দেয়া হচ্ছে শুষ্ক মৌসুমে মোট পানির সেটি মাত্র ০.২৩%।

যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা যাচ্ছে, এবার ভারতকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের সম্মতি দেয়া হয়েছে সাতটি শর্ত:
- ‘লঞ্চিং অ্যাপ্রোচ’-এর প্রশস্ততা ৭.৬৫ মিটারের পরিবর্তে ৪.৫ মিটার হবে।
- পাম্পের বৈশিষ্ট্য চূড়ান্ত হলে বাংলাদেশে সরবরাহ করতে হবে।
- ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১.৮২ কিউসেকের বেশি হবে না, যা উভয় দেশের প্রকৌশলীরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে।
- বাস্তবায়নের পর উভয় দেশের প্রকৌশলীদের দ্বারা পাম্পের সক্ষমতা যাচাই করা হবে।
- ত্রিপুরার সাবরুম শহরে ১.৮২ কিউসেক পানি সরবরাহ পাইপ একটির বেশি হবে না।
- ইনটেক ওয়েলের (কূপ) অবস্থান যৌথভাবে উভয় দেশের প্রধান প্রকৌশলীগণ নির্ধারণ করবেন।
- ইনটেক ওয়েলের বিপরীতে ফেনী নদীর বাংলাদেশের দিকে ভাঙন দেখা দিলে ভারতীয় পক্ষ উক্ত অংশের নদী তীর সংরক্ষণমূলক কাজ বাস্তবায়ন করবে।

 

সীমান্তের ওপারে ফেনীর পানি তোলার জন্য ভারতের তৈরি ‘পাম্পঘর’।

 

১৭ বছর ধরেই পানি তুলছে ভারত :
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে ফেনী নদীতে বর্ষা মৌসুমে ৮-১০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে এ পানির প্রবাহ থাকে সর্বোচ্চ ৫০ কিউসেক।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যেখানে পানি পরিমাপ করে, ভারত তার ৫ কিলোমিটার উজানে পানি পরিমাপ করে থাকে।

যৌথ নদী কমিশনে ভারতীয় তথ্য অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে ফেনী নদীতে পানি প্রবাহ থাকে ১০৯ কিউসেক।

কে এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যে ফিগারটা তারা বলছে এবং আমাদের হাতে আছে সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। এটা নিয়ে আমরা একটা কমিটি অচিরেই মিটিং করতে যাচ্ছি। সেখানে এগুলো ফাইনাল করতে পারবো। এই ডাটাগুলো আসলে সঠিক নয় এই মুহূর্তে।’

এদিকে, ফেনী নদীতে চুক্তি ছাড়াই পাম্প বসিয়ে পানি তোলার অভিযোগ আছে।

ত্রিপুরার সাবরুমে খাবার পানি সরবরাহের জন্য উজানে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার হলে কোনো ক্ষতি হবে কিনা সে প্রশ্নের চেয়ে স্থানীয় মানুষের কাছে বিদ্যমান ভারতীয় পাম্পগুলো নিয়েই প্রশ্ন।

রামগড় এলাকায় গিয়ে নদীর তীরে ভারতীয় অংশে এরকম পানির পাইপ এবং পাম্প মেশিনের অস্তিত্ব দেখা গেছে।

স্থানীয়রা একটি নদীতে একটি পাইপলাইন এবং তার পাম্পঘর দেখিয়ে বলেন, ২০০২ সাল থেকে এখান থেকে পানি তুলছে ভারত।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ নিয়ে প্রতিবাদ করা হয়েছে বলেও জানা যায়।

রামগড়ে অবস্থিত ৪৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল তারিকুল হাকিম বিবিসিকে বলেন, সীমান্তে ৩৬টি এরকম পাম্প মেশিন দিয়ে পানি তুলছে ভারত। নোম্যান্স ল্যান্ড থেকে এগুলো সরিয়ে নিতে বিএসএফ’র সাথে বৈঠকে তাগাদা দেয়া হলেও জানানো হয়েছে, এটি তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়।

উজানে বাংলাদেশ অংশে তিনটি পাম্প দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পানি তোলা হয় বলেও স্থানীয় মানুষের কাছে জানা গেছে।

ওয়ারপো’র সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, ১.৮২ কিউসেক পানি দেয়ার চুক্তি হয়েছে সেটা তেমন কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু এখনই যে পাম্পগুলো ভারতের অংশে বসানো আছে তার প্রতিটির ন্যূনতম ক্ষমতা দুই কিউসেক।

‘২০ বছর আগে ফেনী নদীতে শুষ্ক মৌসুমে ১২০ কিউসেক পানির প্রবাহ ছিল। সেটা এখন ৫০ কিউসেকে নেমে এসেছে। এর কারণ তারা উজানে পাম্প দিয়ে পানি প্রত্যাহার করছে। যদি এখন ১.৮২ কিউসেক নেয়া হয় তাহলে অন্যান্য যে ৩৬টি পাম্পে তারা পানি উঠাচ্ছে তার কী হবে?’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য কে এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অফিশিয়ালি এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নাই। তারা যদি তুলে থাকে সেটা হতে পারে। আমরাও আমাদের অংশে প্রয়োজনে পানি তুলে থাকি। এটা ঠিক একতরফা না। উভয়ের প্রয়োজনে উভয়ে তুলে থাকে। এটা চুক্তিবহির্ভূত যে নদীগুলো আছে সেখানে হয়ে থাকে। সেজন্য ভবিষ্যতে যাতে সেটা না হয় সেজন্য সাতটি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হতে যাচ্ছে। তখন এগুলো সমাধান হয়ে যাবে।’

সূত্র : বিবিসি

 


আরো সংবাদ



premium cement