২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভীতির কবলে নগরশিশুরা

-

আয়েশা বেগমের দুই সন্তান। মেয়ের বয়স ১০, ছেলের সাত। আয়েশা বেগম বলেন, সন্তানেরা যেভাবে সব কিছুতে ভয় পাচ্ছে, তাতে তাদের নিয়ে আমরা ভয়ে আছি। দুই সন্তানের কেউ-ই এখনো রাতে একা বাথরুমে যেতে পারে না। যাওয়ার আগে অবশ্যই কাউকে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিতে হবে। এরপর বাথরুমের সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেই চলবে না। নানা ধরনের শব্দ করে, কথা বলে তাদের জানান দিতে হবে যে, আমি বা কেউ দাঁড়িয়ে আছি সেখানে। তা না হলে তারা বাথরুম করতে পারে না। পেশাবের প্রচণ্ড চাপ নিয়েও বসে থাকে। কিন্তু একা যেতে পারে না। জোর করে ঢুকিয়ে দিলেও চিৎকার করে, দাঁড়িয়ে থাকে দরজার পাশে। বাথরুমের মধ্যে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পেশাব করে দেয় কিন্তু কমোডে গিয়ে বসে না ভয়ে।

আয়েশা বেগম বলেন, তারা শুধু যে বাথরুমে যেতে ভয় পায় তা নয়। তাদের কেউই রাতে এক রুম থেকে আরেক রুমেও যেতে পারে না যদি রুমে কেউ না থাকে। আলো জ্বালানো থাকলেও যেতে পারে না। না থাকলে তো যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। অনেক সময় দেখা যায় অন্য রুমে কোনো বই, খাতা বা কলম পেনসিল বা প্রয়োজনীয় কিছু আছে। তা আনতে বললে আনতে পারে না। হয় তারা দুইজন এক সাথে যায় অথবা আমাদের যেতে হয়। আয়েশা বেগম বলেন, তারা এতই ভীতু যে, আমাদের বাসায় এক রুম থেকে আরেক রুমে যেতে ড্রয়িং রুম পার হয়ে যেতে হয়। অন্য রুমে যাওয়ার পথে যদি ড্রয়িং রুমে আলো না থাকে তাহলে তারা ড্রয়িং রুমের সামনে দিয়ে যেতে পারে না। অনেক সময় যেতে বাধ্য করলে বা বকাঝকা করলে চোখ বন্ধ করে দৌড় দেয়।

শিশুরা যাতে ভয় না পায় সে জন্য সন্ধ্যার পর সব রুমে কেউ না থাকলেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়।

রাজধানীর শ্যাওড়াপাড়ার বাসিন্দা আয়েশা বেগম বলেন, শিশুদের এ ভয় নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি। অনেক সময় খুবই রাগ হয় তাদের ওপর। মারধরও করেছি। বুঝিয়েছি ভূত বলতে কিছু নেই। জানালার পাশে নিয়ে বলেছি ওই যে দেখ বাইরে আলো জ্বলে, কত মানুষ হাঁটাচলা করছে। আর তোমরা ঘরের মধ্যে বসে ভয় পাচ্ছ? কিন্তু কাজ হয় না। ১০ বছর বয়সেও যদি সবসময় সাথে নিয়ে বাথরুমে যেতে হয়, বাথরুমের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাহলে অনেক সময় মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আগে বাথরুমের দরজা বন্ধ করতেও ভয় পেত। এখনো দরজা না লাগিয়ে একটু ফাঁকা রাখতে হয়। আবার দেখা গেল বাথরুমে ঢোকার পর একটা তেলাপোকা চোখে পড়ল তখন চিৎকার করে দৌড়ে বের হয়ে যায় আমার মেয়ে। এমনকি মরা তেলাপোকা বাথরুমে পড়ে থাকলেও বের হয়ে আসে বাথরুম না করে।

আয়েশা বেগম বলেন, তাদের অনেক বুঝিয়েছি ভূত বলতে কিছু নেই। তোমাদের সাথে সব সময় ফেরেশতা আছে। ফেরেশতার কথা বলায় তারা অন্য ভয় পাওয়া শুরু করেছে। তারা শুনেছে অদৃশ্য জিন আছে। জিনদের সম্পর্কে কিছু জানতে পেরে এখন ভয় পায় কখন তারা বিভিন্ন সুরত ধরে তাদের কাছে এসে পড়ে। অন্ধকারে এক মুহূর্তও একা থাকতে পারে না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে চিৎকার করে ওঠে। অন্ধকারে ভো দৌড় দিয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরে।

শিশুরা কেন এত ভয় পায় তার কারণ জানা আছে কি না জানতে চাইলে আয়েশা বেগম বলেন, আমি অনেকের সাথে এ নিয়ে আলাপ করেছি। আমাকে তারা বলেছেন তাদের শিশুরাও এভাবে কম বেশি ভয় পায়। তা ছাড়া আমি লক্ষ্য করেছি কার্টুনে যদি কখনো ভূতের কোনো বিষয় আসে, বা ভূতের কার্টুন দেখে তখন তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি চেপে বসে। তখন হালকা অন্ধকারে কোনো কিছু নড়ে উঠলেও তারা ভয় পায়। তারপর থেকে তাদের কার্টুন দেখা কমিয়ে দিয়েছি। বিশেষ করে ভূত জাতীয় কোনো কিছু আছেÑ এমন কোনো কার্টুন বা ছবি তাদের দেখতে দেই না। এতে অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

আজিমপুরের গৃহিণী হামিদা বেগমের দুই মেয়ে। ছোট মেয়ের বয়স ৯ বছর। বড় মেয়ে পড়ে নবম শ্রেণীতে। হামিদা বেগম বলেন, এক বছর আগেও ছোট মেয়ে একা বাথরুমে যেতে পারত না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তবে এখন আর লাগে না। বাথরুমের লাইট জ্বালানো না থাকলেও সে নিজে জ্বালিয়ে নিতে পারে। তবে বাথরুমের চারপাশে আলো জ্বালানো না থাকলে সে এখনো একা বাথরুমের সামনে যেতে সাহস করে না। আর অন্ধকারে তারা এখনো কেউ একা বা দুইজনও সামান্য সময়ও থাকতে পারে না। বাথরুমে থাকা অবস্থায় যদি বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে চিৎকার করতে থাকে।

হামিদা বেগম বলেন, শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় তেলাপোকা। একবার ঘুমের মধ্যে আমার ছোট শিশুর গায়ে তেলাপোকা উড়ে এসে পড়ে এবং তাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। এতে সে প্রচণ্ড ভয় পায়। পানিপড়া খাওয়াতে হয়েছে। অনেক দিন লেগেছে তার ভয় কাটতে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, আমরা সবাই বসে আছি তার সামনে এ অবস্থায় দরজা বা জানালার পর্দা নড়ে উঠলেও সে ভয় পেত।

শিশুদের ভয় পাওয়া নিয়ে যেসব মাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তারা প্রায় সবাই প্রথমেই এক বাক্যে বলে উঠেছেন, ওরে সর্বনাশ! ভয় পায় না মানে? ভয়ে সারাক্ষণ অস্থির। তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছেন কার্টুন, ভূতের গল্প, সহপাঠীদের কাছ থেকে নানা ধরনের গল্প শোনার কারণে তাদের মধ্যে ভয় চেপে বসে। ঘরের মধ্যে হালকা অন্ধকারে কিছু নড়ে উঠতে দেখলেও ভয়ে চিৎকার করে বা দৌড় দেয় অনেক শিশু। সাত-আট বছর পর্যন্ত কেউই একা বাথরুমে যেতে পারে না রাতে। শহরের শিশুদের ভয়কে অনেক মা-বাবাই অতিরিক্ত ভয় পাওয়া হিসেবে দেখছেন এবং নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখি হচ্ছেন তারা।

রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: নারগিস রহমান এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, শিশুদের এ ধরনের ভীতু হিসেবে বেড়ে ওঠার পেছনে কাজ করছে, তাদের ওপর পারিপার্শিক নানা প্রভাব এবং উপাদান। শিশুদের নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে খাওয়ানো বা কোনো কিছু করতে বাধ্য করার যে প্রবণতা মা-বাবার মধ্যে ছিল তা এখন শহরের শিক্ষিত সচেতন মা-বাবাদের মধ্যে অনেকে কমেছে। কিন্তু তার পরও শহরের শিশুরা এখন অতিরিক্ত ভয় পাচ্ছে। এর কারণ প্রযুক্তির কারণে তারা অতি সহজে এখন ভৌতিক নানা ধরনের কার্টুন, ভূতের ছবি, সিরিয়াল, নাটক দেখে, যা থেকে তাদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে। তা ছাড়া শহরের শিশুরা আজকাল অনেক বেশি নিঃসঙ্গতার শিকার। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে মা-বাবা উভয়েই চাকরি করে। এ অবস্থায় শিশুরা নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হয় অন্যদের দ্বারা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা মা-বাবার হাতেও অনেক বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে পড়ালেখা নিয়ে করে তারা এ নির্যাতনের শিকার হয়। এসবেরও প্রভাব রয়েছে শিশুদের অতিরিক্ত ভয় পাওয়া, নিজেকে গুটিয়ে রাখা বা সহজে মুষড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, যেসব কারণে শিশুরা ভীতু হচ্ছে তা দূর করতে না পারলে বড় হলেও তাদের মধ্যে এর প্রভাব থেকে যায় নানা মাত্রায়।


আরো সংবাদ



premium cement