সিরিয়ার তরুণ কুর্দি নেতা হেভরিন খালাফকে কারা হত্যা করলো?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:০৪, আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:৩৩
সিরিয়ার তরুণ কুর্দি নেতা হেভরিন খালাফকে তুরস্কপন্থী সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির একটি দল হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিবিসি'র নিউজ অ্যারাবিকের তদন্তের পর এই অভিযোগ করা হয়।
তবে আহরার আল-শারকিয়া নামে ওই গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, এই মৃত্যুর জন্য তারা দায়ী নয়।
কে ছিলেন হেভরিন খালাফ?
৩৪ বছর বয়সী হেভরিন খালাফ সিরিয়ার সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কয়েক বছর ধরে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকা যা কুর্দি ভাষায় রোজাভা নামে পরিচিত, সেখানে তুর্কি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি একটি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমতা
এই তরুণ রাজনীতিবিদ ফিউচার সিরিয়া পার্টির প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন, যাদের লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার খ্রিস্টান, কুর্দি এবং আরবরা যেন পাশাপাশি কাজ করতে পারে।
এ অঞ্চলটি পুনর্গঠনে তাদেরকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
হেভরিন খালাফের সহকর্মী, বন্ধু এবং সাবেক রুমমেট নুবার মোস্তফা বলেন, 'আমি আমার একজন বোন, একজন কমরেড, একজন নেতা এবং কর্মস্থলে আমাদের কমরেডরাও তাদের একজন নেতাকে হারিয়েছে।'
'আমরা এমন এক নারীকে হারিয়েছি, যিনি অন্য নারীদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। যিনি মানুষের ক্ষমতায়ন চেয়েছিলেন এবং শান্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন।'
২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর ভোর সাড়ে ৫টার দিকে হেভরিন খালাফ, উত্তর সিরিয়ার আল-হাসাকাহ শহর থেকে রাক্কায় তার পার্টির সদর দফতরের উদ্দেশ্যে নিজে গাড়িতে রওনা হন।
সেখানে যাওয়ার জন্য তিনি পশ্চিমের এমফোর মোটরওয়ে ব্যবহার করেন। বাড়ি আর কর্মস্থলের এলাকা দুটি তিন ঘণ্টার দূরত্বে ছিল।
মার্কিন সেনারা ওই অঞ্চল থেকে সরে আসার মাত্র তিন দিন হয়েছিল।
এর মধ্যে তুর্কি সেনাবাহিনী সিরিয় সীমান্ত অতিক্রম করে সামরিক অভিযান শুরু করতে পারবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানকে এমন অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।
এমফোর মোটরওয়েটি ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি কোথাও ছিল না।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, তারা একটি সামরিক কনভয়কে তুরস্ক থেকে সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে দক্ষিণে এমফোর মোটরওয়ের দিকে যেতে দেখেছে।
টেলিগ্রামে ভিডিও
এ কনভয়টি তুরস্কপন্থী সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি-এসএনএ এর একটি অংশ ছিল। এর সাথে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কথা নয়।
এসএনএ হলো ২০১৯ সালে ৭০ হাজারেরও বেশি সৈন্য এবং ৪১টি দল নিয়ে তুরস্কের গঠিত একটি আমব্রেলা গ্রুপ বা ছদ্ম দল।
তুরস্ক এই দলগুলোকে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দেয়।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার পর থেকে তারা উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীর সাথে লড়াই করে আসছে।
২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর, আহরার আল-শারকিয়া নামে একটি গোষ্ঠী, টেলিগ্রাম নামের একটি এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনে ভিডিওগুলো পোস্ট করে।
এক ভিডিওতে, গোষ্ঠীটি এমফোর মোটরওয়েতে তাদের আসার কথা ঘোষণা করে।
ভিডিওতে সূর্যোদয় দেখা যায় এবং তাদের আসার সময়টি ছিল সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে।
এর মধ্যে একটি ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি কংক্রিটের ব্যারিকেড, একটি টেলিফোনের খুঁটি এবং একটি ধুলোয় ছাওয়া রাস্তা দেখা যায়।
স্যাটেলাইট চিত্রগুলোর সাথে এই জায়গাটির অবস্থান তুলনা করে বিবিসি, যাতে দেখা যায় যে ভিডিওটি তিরওয়াজিয়া চৌকিতে ধারণ করা হয়েছিল।
১২ অক্টোবর সকালে এই চৌকিটি ধরেই হেভরিন খালাফ তার গাড়ি নিয়ে যাত্রা করছিলেন।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
ভিডিওগুলো তখন অন্ধকারের দিকে মোড় নেয়, যেখানে তিনজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়, যাদেরকে বলা হয় তারা পিকেকে যোদ্ধা।
পিকেকে হলো একটি কুর্দি সশস্ত্র দল যারা কয়েক দশক ধরে তুর্কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
একটি ভিডিওতে, আহরার আল-শারকিয়া গোষ্ঠীর একজন তার এক সহকর্মীকে বলতে শোনা যায়, তিনি মাটিতে পড়ে থাকা কাউকে গুলি করার সময় সেই দৃশ্য যেন ভিডিওতে ধারণ করেন।
এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য ধারণ করা হয় তিরওয়াজিয়া চেকপয়েন্টে।
আহরার আল-শারকিয়া কী বলছে?
আহরার আল-শারকিয়া প্রথমে সেখানে উপস্থিত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। কিন্তু পরে দলটি বিবিসিকে এক বিবৃতিতে জানায় যে, 'সেদিন এমফোর মোটরওয়েতে যে ব্যক্তি কোনো অনুমতি ছাড়াই রোড ব্লক স্থাপন করেছিল... যারা নেতৃত্বের আদেশ লঙ্ঘন করেছিল তাদেরকে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে।'
আহরার আল-শারকিয়া আরো বলেছে যে, তারা একটি গাড়িতে গুলি চালিয়েছিল। তারা দাবি করেছে যে তারা ওই গাড়িটিকে থামতে বললেও সেটা থামেনি।
কিন্তু দলটি জোর দিয়ে বলছে যে তারা হেভরিন খালাফকে টার্গেট করেনি এবং কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেটা তারা জানে না।
বিবিসির অনুসন্ধান
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আহরার আল-শারকিয়ার পোস্ট করা নিজস্ব ভিডিও এবং এক প্রত্যক্ষদর্শী যিনি বিবিসি নিউজ অ্যারাবিকের সাথে বিশেষভাবে কথা বলেছেন- এই দুটি বিষয় এমন ইঙ্গিত দেয় যে ওই কুর্দি রাজনীতিবিদকে এই গোষ্ঠীর লোকেরাই হত্যা করেছে।
বিবিসির ভূ-অবস্থান বা জিওলোকেশন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হেভরিন খালাফের গাড়িটি তিরওয়াজিয়া চৌকির পাশে যে রাস্তা তার বাইরেই ছিল।
সেদিন আহরার আল-শারকিয়ার পোস্ট করা সর্বশেষ ভিডিওতে, যোদ্ধাদের হেভরিনের গাড়িটি ঘিরে থাকতে দেখা গেছে।
গাড়ীটির মেঝেতে একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়, সেটা হেভরিনের ড্রাইভার ফরহাদ রমজানের বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভিডিওটির এক পর্যায়ে গাড়ির ভিতরে থেকে যখন কোনো নারীর ম্লান কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
'এই পৃথিবীতে কোনো মানবতা নেই'
'এটি হেভরিনের কণ্ঠস্বর। আমি পাঁচ হাজার কণ্ঠের মধ্যেও তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারবো,' হেভরিনের মা সৌয়াদ মোহাম্মদ বিবিসিকে বলেন।
'যখন আমি তার কণ্ঠ শুনেছি, আমি বিশ্বের বর্বরতা দেখেছি এবং এই পৃথিবীতে কোনো মানবতা নেই।'
দেখা যাচ্ছে যে, হেভরিন খালাফ বেঁচে ছিলেন এবং গাড়ি থামানোর সময় যোদ্ধাদের কাছে নিজের পরিচয় দিতে সক্ষম ছিলেন।
এছাড়াও প্রমাণ আছে যে, তিনি গাড়ির ভিতরে মারা যাননি।
যে কৃষক বিবিসির সাথে বিশেষভাবে কথা বলেছিলেন এবং তার পরিচয় গোপন রাখতে বলেছেন, তিনি জানান যে, আহরার আল-শারকিয়ার বিদ্রোহীরা যখন সেখানে পৌঁছায় তখন তিনি ওই চৌকির পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন।
সকাল সাড়ে ৭টায় যোদ্ধারা পিছু হটে যাওয়ার পরে তিনি ঘটনাস্থলে যান।
ওই কৃষক বলেছেন, ''এটি একটি ভয়াবহ দৃশ্য ছিল, 'আমি প্রথমে যাকে দেখেছি তিনি ছিলেন একজন নারী। তার দেহ গাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ মিটার দূরে পড়ে ছিল ... তার মুখটি সম্পূর্ণরূপে বিকৃত ছিল, এবং তার পা সত্যিই খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সম্ভবত ভাঙ্গা।"
ওই কৃষক তিরওয়াজিয়া চৌকিতে এমন নয়টি লাশ দেখতে পান।
'স্থানীয়রা লাশ গাড়ীতে রাখার জন্য আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিল। তারা ভয় পেয়েছিল যে তাদেরও হত্যা করা হবে।'
বন্দুকের ২০টি গুলির আঘাত
২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর রাত ১২টায় হেভরিনের লাশ এবং আরো তিনটি লাশ মালিকিয়ার সামরিক হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া হয়।
সে সময় বিতরণ করা একটি মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয়, হেভরিন খালাফকে ২০বারেরও বেশি গুলি করা হয়েছিল। তার দুই পা ভেঙে গিয়েছিল এবং তিনি গুরুতর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
বিবিসি অ্যারাবিকের ধারণা যে, আহরার আল-শারকিয়া যোদ্ধারা হেভরিনকে জীবিত অবস্থায় গাড়ি থেকে টেনে নামায়, এরপর হামলা চালিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং গাড়ির বাইরে হত্যা করে।
আহরার আল-শারকিয়া বিবিসিকে বলেছে যে, 'আমরা হেভরিন খালাফকে হত্যার দায় বেশ কয়েকবার পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করেছি।'
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনার, হেভরিন খালাফ হত্যার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করার জন্য তুরস্ককে অনুরোধ করেছেন।
কিন্তু এখনও সেই তদন্ত হয়নি।
উত্তর সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক আক্রমণ শুরুর পর থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলে আসছেন যে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে এবং শান্তির সুরক্ষার জন্য সামরিক অভিযানের প্রয়োজন ছিল।
তুরস্কের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য নেই
অক্টোবরে মার্কিন সেনা ওই অঞ্চল থেকে সরে আসার পর হেভরিন সেই কয়েকশো মানুষেরই একজন যাকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবিসিকে জানিয়েছে, "আহরান আল-শারকিয়া যে হেভরিন খালাফ এবং অন্যদের হত্যা করেছে তা অবশ্যই স্বাধীনভাবে তদন্ত করা উচিত এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
তুরস্ক যতক্ষণ পর্যন্ত না তার প্রক্সি বাহিনীর উপর লাগাম টানছে এবং সহিংসতার পেছনে দায়ীদের রেহাই দেয়া বন্ধ করছে ততোক্ষণ পর্যন্ত নৃশংসতাকে আরও উৎসাহিত করা হবে।"
বিবিসি তুরস্ক সরকারের কাছে এই ঘটনায় একটি মন্তব্য দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা