২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিসরে অদ্ভুত বিচারব্যবস্থা

মিসর
মিসরের একটি আদালত - ছবি: সংগৃহীত

‘নীল নদের পানি পান করলে অন্য কেউ অসুস্থ হতে পারে’ এমন ইঙ্গিত দেয়ায় মিসরে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন গায়িকা শিরিন আবদেল ওয়াহাব। ‘উত্তেজক’ নীল মন্তব্যে কিংবা ‘উসকানিকমূলক প্রচার চালাচ্ছে’ অভিযোগে তাকে শুধু বিচারের মুখোমুখিই হতে হয়নি; রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন তার গান প্রচার করবে না। কারণ তিনি গানের মাধ্যমে রাষ্ট্র অপমান করেছেন এবং পর্যটনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত কনসার্টে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- মাশরেবতেস মেন নিলহা অর্থাৎ আপনি কি নীল থেকে নেশা করেছেন? তিনি জবাবে বলেন, ‘(নীল নদ থেকে পান করলে) তোমার বিলহারজিয়া (একটি রোগ) হবে’। তুমি এভিয়ান পান করতে পার, যা এর চেয়ে ভালো।

মিসরের সঙ্গীতশিল্পীরাও এটিকে ‘আমাদের প্রিয় মিসরের অসম্মানিত উপহাস’ বলে মন্তব্য করেন এবং এটি প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গানের ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার পর একটি মামলা করা হয়। আসলে নদীর দূষিত পানি যে কাউকে অসুস্থ করতেই পারে! তার পরও গায়িকা কনসার্টে তার মন্তব্যের জন্য মা চেয়েও শেষ রক্ষা পাননি। তিনি বলেন- ‘আমার প্রিয় দেশ মিসর এবং মিসরীয় আমার দেশের সন্তানেরা, আমি আপনাদেরকে ব্যথা দিয়েছি তার জন্য আপনাদের কাছে আমার হৃদয়ের সব উজাড় করে দিয়ে মাপ্রার্থনা করছি।’ এই শিল্পী ক্ষমা না পেলেও অনেক দেশের মানুষই এই অদ্ভুত বিচার নিয়ে হাসাহাসি করেছে।

মিসরের অন্যতম এক জনপ্রিয় টকশোতে টিভির পর্দা দু’টি অংশ বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশে দৃশ্যমান হয় পুতুলের মতো একটি চরিত্র। এ দিকে পর্দার বাকি অংশ জুড়ে এক ভয় ধরানো কিশোরের আবির্ভাব ঘটে, যে পুতুলটিকে কারাগারে পাঠানোর হুমকি প্রদান করতে থাকে। উপস্থাপক, পুতুল আবলা ফাহিতা এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রদানকারী কিশোর আহমেদ স্পাইডার- এই দু’জনের মাঝে বিতর্ক চলতে থাকে। আহমেদ স্পাইডার একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেন, যে কিনা তাদের এক বিজ্ঞাপনের সাথে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের গোপন বার্তা ছড়াচ্ছে। ঘটনাক্রমে এই অভিযোগ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কাছে উল্লেখ করা হয়, যারা সন্ত্রাসবাদ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবিষয়ক ঘটনাগুলো দেখাশোনা করে। পরে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ভোডাফোনের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। ইতোমধ্যে মিসরে একটি কবুতর, সারস এবং একটা হাঙ্গর সন্দেহভাজন গুপ্তচরের তালিকায় যুক্ত হয়েছে, এখন আমরা আবলা ফাহিতা নামক পুতুল এবং তার কন্যা ক্যারোলিনা ওরফে কারকোউরাকে এই তালিকায় যুক্ত করতে পারি। মিসরীয় নাগরিকেরা এমন সংবাদ নিয়ে ঠাট্টা-ব্যঙ্গ করেছেন, ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

হলিউডের ছবি ‘আই লাভ ইউ, ম্যান’-এ কুকুরের নাম রাখা হয় ‘আনোয়ার সাদাত’। মার্কিন সিনেমায় কুকুরের নাম আনোয়ার সাদাত রাখায় মামলা করে মিসরের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের মেয়ে রোকেয়া সাদাত। কেননা কুকুরটির নাম আনোয়ার সাদাত রেখে তার বাবাকে অপমান করা হয়েছে, সাথে সাথে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে মিসরকে ও মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির নেতৃত্বের ভূমিকাকে। কুকুরের নাম আনোয়ার সাদাত রাখায় মামলা হয়, আদালত ছবিটির প্রদর্শনী বন্ধ ঘোষণা করে এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধেও মামলা করে। আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলো বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করে।

এসব হালকা ব্যাপারেও বিচারব্যবস্থা যেখানে এত তৎপর সেখানেই আদালতের কাছে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় জরুরি ভিত্তিতে বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করার আবেদন জানিয়ে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন না। মুরসি বলেছেন, ‘আমি আমার বাম চোখে কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’ মিসরীয় আদালত দুটি মামলার একটিতে গুপ্তচরবৃত্তি ও কাতারে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে ২০১৫ সালের জুনে মুরসিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে এবং ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে ‘মিসরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।

মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ অভিযোগ করেছে- মিসরে বন্দীদের ওপর ব্যাপক মাত্রায় যৌনসহিংসতা চালাচ্ছে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনী। বন্দীদের অনেকে কুমারিত্ব পরীক্ষা, ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া গণবিক্ষোভ বন্ধ করার জন্য পুরুষ, নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ২০১৩ সালে মিসরের সেনাবাহিনী মতা দখলের পর থেকেই বন্দীদের ওপর যৌননির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এসব অপরাধে জড়িতদের কোনো শাস্তি হয় না। দৃশ্যত বিরোধী মত স্তব্ধ করে দেয়ার কাজে নিরাপত্তাবাহিনীকে ব্যবহার করার জন্য দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। বন্দীদের ওপর এ ধরনের অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছে পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।

প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাতাহ আল-সিসির শাসনামলে ইসলামপন্থীদের এবং সরকারের সমালোচনা করার কারণে হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে। মিসরে তিন ভাগের এক ভাগ নারী স্বামী দ্বারা প্রতারিত হন লিখে একজন ব্লগার শাস্তি পেয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করায় একজন আইনজীবী রামাদানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ বছর গৃহবন্দী রাখার সাজা দেয় আদালত। ফেসবুক ব্যবহার করে ঐক্য নষ্ট করার এবং সহিংসতায় ইন্ধন দেয়ার অভিযোগে ২০১৫ সালে পাস করা আইনের অধীনেই সাজা দেয়া হয় তাকে। ফেসবুক পেজে রামাদান লিখেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন মিসরের বর্তমান সরকার খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না।

মিসরের একটি আদালত মিথ্যা খবর প্রচারের অভিযোগে আলজাজিরা টেলিভিশনের কানাডার সাংবাদিক মোহাম্মদ ফাহমি ও মিসরের প্রযোজক বাহের মোহাম্মদ এবং অস্ট্রেলিয়ার পিটার গ্রেস্টকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।

আদালতের অনেক গুরুত্বহীন ব্যাপারে মনোযোগ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হালকা ধরনের রায় মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খাটো করছে; অথচ ন্যায়বিচার স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়। যেকোনো বিচারেই বিচারব্যবস্থা সভ্যসমাজের নির্দেশক। বিচারব্যবস্থাহীন সমাজে মানুষ কেন পশুও নিরাপদে বাস করতে পারে না।


আরো সংবাদ



premium cement