১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কেন এতো অস্ত্র কিনছে উপসাগরীয় দেশগুলো?

সৌদি আরব
সৌদি আরবের ডিএফ-৩ মিসাইল - ছবি: সংগৃহীত

উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে নানা ধরনের সন্দেহ অবিশ্বাস ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে বাড়ছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা। এই সুযোগে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলে অস্ত্র ব্যবসায়ের দরজা খুলে দিয়েছেন। ফলে পাইলট নেই, তবু কেনা হচ্ছে যুদ্ধবিমান।

পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র কাতারের সামরিক ক্ষমতার জন্য পরিচিতি কখনো ছিল না। অথচ ডিসেম্বরে কাতারের জাতীয় দিবসে যুদ্ধবিমানগুলো শোঁ শোঁ শব্দ করে উড়ছিল। যেখানে ফ্রান্সের তৈরি ছয়টি মিরেজ ফাইটার, ছয়টি কার্গো প্লেন এবং প্রশিক্ষকদের একটি স্কোয়াড্রন ছিল। বিমানবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে ৯৬টি নতুন জেট কিনতে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কাতার সরকার। নতুন জেটগুলোর মধ্যে রয়েছে আমেরিকার এফ-১৫, ব্রিটেনের টাইফুন এবং ফ্রান্সের রাফালে।

সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাতারের এসব চুক্তির পর বাহরাইন, মিসর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। এসব দেশের অভিযোগ কাতার যেন সন্ত্রাসে সমর্থন দেয়া বন্ধ করে। তবে কাতার জোরালোভাবে সন্ত্রাসে সমর্থনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। অবরোধের পর কাতারের জাতীয়তাবোধ বেশি জেগেছে, সেনাবাহিনী গঠনই তার অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ আল-আত্তিয়া বলেছেন, ‘আমাদের প্রয়োজন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিও মোকাবেলার জন্য পরিকল্পনা করা। আমি এখন ২৫ বিলিয়ন ডলার যথেষ্ট মনে করছি না।’

কাতারের বিমান বাহিনীতে নতুন জেট অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে পশ্চিমাবিশ্বের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা আশ্চর্য হয়েছেন। কাতারের সেনাসদস্য মাত্র ২৭ হাজার ৫০০ জন, বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১০ শতাংশেরও কম সৈন্য। যা সম্প্রসারিত করতে আরো শত শত নতুন পাইলটের প্রয়োজন। গত বছর দেশটির বিমান বাহিনীর অ্যাকাডেমি থেকে মাত্র ৩০ জন স্নাতক বেরিয়েছে। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছে দেশটি। তিনটি ভিন্ন প্লাটফর্মে তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

অন্য দিকে, বাহরাইন এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান দ্বিগুণ করার জন্য প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমানবাহিনী আমেরিকার সাথে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গত ৯ জুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাতারকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক ঘোষণার পাঁচ দিন পর আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব কাতারের সাথে এফ-১৫ বিক্রির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।

গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের সময় ১১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করে সৌদি আরব। আগামী ১০ বছরে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি ক্রয়েরও চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সামরিক অস্ত্র উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ দেশটিতে রফতানি করেছে। পাচ্ছে ১৫০টি আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার ‘ব্ল্যাক হক’, যা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অ্যাটাক হেলিকপ্টার বহর। রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক এবং চড়া মূল্যের লকহিড মার্টিনের এন্টি ব্যালাস্টিক মিসাইল রাডার। রাশিয়ার এস-৪০০ অত্যাধুনিক পেণাস্ত্র প্রতিরা ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যুক্তরাজ্যের অস্ত্র বিক্রির বড় বাজার সৌদি আরব; গত তিন বছরে কয়েক বিলিয়ন পাউন্ডের অস্ত্র বিক্রি করেছে। সৌদি আরবের কাছে যেসব দেশ অস্ত্র রফতানি করে ফ্রান্স তাদের মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি সামরিক অস্ত্র উৎপাদনবিষয়ক প্রদর্শনী চলাকালে বিভিন্ন দেশের সাথে রিয়াদের অস্ত্র বিক্রিসংক্রান্ত ৩৩টি চুক্তি সই হয়েছে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তাস জানিয়েছে- নিজেদের আকাশসীমার সুরা নিশ্চিত করতে রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ ও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ক্রয়ের পরিকল্পনা করছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাক। তবে আঞ্চলিক বেশ কিছু দেশ চায় না যে, ইরাক সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হোক। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের কিছু দেশ চায় ইরাক মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন থাকুক। আর যুক্তরাষ্ট্র চায় না ইরাক রাশিয়া থেকে এস-৪০০ কিনুক; বরং তারা চায় বাগদাদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বর্তমান চুক্তির আওতায় ইরাকে সমরাস্ত্র থাকতে হবে।

ইসরাইলের কাছ থেকে অস্ত্র ও ড্রোন কিনছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ফ্রান্সের ইনটেলিজেন্স অনলাইন ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের দুই অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যারোনাটিক্স ও আলবেইট সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অস্ত্র জোগান দিচ্ছে। ইসরাইলের বিমানবাহিনীর সাবেক কমান্ডার ইটিন বেন ইলিয়াহু অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যারোনাটিক্স অ্যাভি লিউমির সাথে আমিরাতের ব্যবসায় করার জন্য সাহায্য করেছিলেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, ‘উপসাগরীয় অঞ্চলের গঠনমূলক শক্তিগুলোর সাথে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আমি অবশ্যই কাতারের কথা বলছি না। এ অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি গঠনমূলক শক্তি।’

যুক্তরাজ্য সরকারের ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত নথিগুলোর সূত্রে দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে- অস্ত্রবাজার চাঙ্গা করতেই উপসাগরীয় যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৯০ সালে কুয়েতে ইরাকি অভিযানকে উপসাগরীয় দেশে অস্ত্র বিক্রির দারুণ সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সামরিক সরঞ্জামের জন্য সৃষ্ট চাহিদার সুযোগ ব্রিটিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারীরা নিয়েছিল। প্রতিরা সরঞ্জামাদি রফতানির জন্য এখনো এ দেশগুলোকে টার্গেট করে থাকে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ সরকারের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থা ‘ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন’-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য ৬০০ কোটি পাউন্ড সমমূল্যের অস্ত্র চুক্তি করেছে; যা বিশ্বের অস্ত্রের বাজারের ৯ শতাংশ। এর অর্ধেক চুক্তিই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে করেছে যুক্তরাজ্য।

সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ভিন দেশীদের সামরিক ঘাঁটি তৈরির ফলে ইতোমধ্যে উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। জানুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত দাবি করে, দুটি কাতারি যুদ্ধবিমান তাদের একটি বেসামরিক বিমান চলাচলে বাধা দিয়েছে। বাহরাইনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে সেই বিমান তিনটির রাডার ট্র্যাক দেখায়। বিমানগুলো আসলেই একে অপরের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু কাতারের জেট বিমানগুলো আমিরাতের উড়োজাহাজকে ২০০০ ফুট নিচে নিক্ষেপ করে। উপসাগরীয় অঞ্চলের আকাশে এখন নতুন সামরিক বিমানগুলো ভোঁ ভোঁ করে উড়ে বেড়ানো নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement