২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পুতিনের নতুন খেলা

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পুতিনের নতুন খেলা - ছবি : সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মনে হয় একমাত্র নেতা, যিনি মধ্যপ্রাচ্যের জলকাদায় ভরা তথা- জটিল পরিস্থিতি থেকে সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। একই সময়ে ইরানের কলঙ্কজনক অনৈতিক ও অপরাধমূলক ভূমিকার কারণে গত পাঁচ বছরে সিরিয়ায় অব্যাহতভাবে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

কমপক্ষে ১০ হাজার হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াসহ প্রায় ৫০ হাজার ইরানি সৈন্য এবং সিরিয়ার আকাশে তার বিমানশক্তি নিয়ে পুতিন অদম্য কঠোরতাসহকারে ‘পয়েন্ট অর্জন’ অব্যাহত রেখেছেন। যখন সময় আসবে তখন একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়ে তোলার ব্যাপারে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পুতিন আত্মাভিমানী হয়ে এবং একটি সিদ্ধান্তকারী শক্তি হিসেবে তার কার্যকর নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রদর্শন করছেন। 

১২ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত আলেপ্পোয় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করার জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে যখন রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত, তখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সৈন্যরা ইরান ও হিজবুল্লাহর সরাসরি সহায়তায় ধীরগতিতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং নতুন নতুন ভূখণ্ড দখল করে নিচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক প্রভাবের দিক দিয়ে ওই অঞ্চলে এ পর্যন্ত বিরাজমান শূন্যতার সুযোগ নিয়ে পুতিন চমৎকারভাবে সফল হয়েছেন এবং প্রকৃতপক্ষেই রাশিয়া বেশ সফল হচ্ছে। সিরিয়ায় আমেরিকার একেবারেই কোনো প্রভাব না থাকা এবং ওই অঞ্চলের অন্যান্য অংশে তাদের ভূমিকা ক্রমেই কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পুতিন সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তার দেশকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও তার হাতকে শক্তিশালীভাবে করা এবং একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের রূপদানের ক্ষেত্রে তার দেশের যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে তা বলার এখনই সুবর্ণ সুযোগ। সিকি শতাব্দী আগে যে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং তার সাথে সাথে সুপার পাওয়ার হিসেবে তার দেশের মর্যাদা যে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক। তখন থেকে তিনি এ ব্যাপারেও সচেতন যে, আন্তর্জাতিক পুনঃভারসাম্য প্রক্রিয়া এখনো এগিয়ে যাচ্ছে। শীর্ষ বিশ্ব খেলোয়াড় হিসেবে আলোচনার টেবিলে রাশিয়ার স্থান নিশ্চিত করার এটাই উপযুক্ত সময় মনে করা হচ্ছে।

কোনো কারণে কেউ আগামী কয়েক মাসে এবং কয়েক বছরে ওই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সে ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করলে তথা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করলে অথবা সাঙ্কেতিক লক্ষণগুলো পাঠ করলে কেবল একটি বেদনাদায়ক বাস্তবতাই তিনি দেখতে পাবেন। এই নারকীয় উন্মাদনার অবসান ঘটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধে জড়িত কোনো পক্ষ যুদ্ধের অবসানে সক্ষম হবে না অথবা যুদ্ধের অবসান চাইবে না বলে মনে হয়- এটাই হতাশাজনক ও বেদনাদায়ক। 

এ দিকে সিরিয়ার বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিকই নিজেদের রক্ত দিয়ে এবং ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে এই যুদ্ধের মূল্য পরিশোধ করে যাচ্ছেন। প্রতি সেকেন্ডে একজন করে সিরীয় উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। ২০১১ সালের মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটি থেকে এক কোটি ১০ লাখ লোক বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। যুদ্ধ পঞ্চম বছরে পদার্পণ করার পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ার অভ্যন্তরেই এক কোটি ৩৫ লাখ মানুষ মানবিক সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। এটা একটা নজিরবিহীন ট্র্যাজেডি। জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের তথ্যানুসারেÑলেবানন, তুরস্ক, মিসর ও ইরাকে ৪৮ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তু আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে বাড়িঘর ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন ৬৬ লাখ সিরীয়। অধিকন্তু সিরিয়ার ১০ লাখ নাগরিক ইউরোপ, প্রধানত জার্মান ও সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোকেও এ ধরনের আশ্রয়দানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। 

গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা করতে গিয়ে জাতিসঙ্ঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুন আলেপ্পোয় বাংকার ধ্বংসকারী বোমা হামলা চালানোর মাধ্যমে সহিংসতাকে নতুন করে বর্বরতার আরো গভীরে নিয়ে যাওয়ার নিন্দা করেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই ল্যাভরভের মধ্যকার কথিত যুদ্ধবিরতি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে সার্বিকভাবে আমেরিকার কৌশলের একটি অত্যাবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের প্রতিনিধিত্বকারী না হওয়ায় সেটা মস্কো আর তেহরান উভয়ের জন্য স্বস্তিদায়ক। অবশ্য সিরিয়া এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রাশিয়া ও ইরানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হবেন।

এক দিকে, পুতিনের জন্য ওই অঞ্চলে রাশিয়ার সত্যিকার অর্থে একমাত্র মিত্র হচ্ছেন বাশার আল আসাদ। আবার বাশারের ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে মস্কোর বদান্যতা, সাহায্য এবং সামরিক সুরক্ষার ওপর নির্ভর করছে। এ ছাড়াও, সিরিয়া মস্কোকে রাশিয়ার বাইরে তার একমাত্র বৈদেশিক ভূমধ্যসাগরীয় নৌঘাঁটিটি ব্যবহার করতে দিচ্ছে। অপর দিকে, ওই অঞ্চলে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের উচ্চাভিলাষ পূরণ করার জন্য তেহরানকে অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি উপাদান সরবরাহ করার ক্ষেত্রে একটি মক্কেল রাষ্ট্র হিসেবে দামেস্ক সরকার ভূমিকা পালন করার পর থেকে সিরিয়া ইরানের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ‘যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সুপার পাওয়ার; কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এটা স্পষ্ট করেছেন যে, তার দেশের বিদেশে যুদ্ধ করার আর কোনো ইচ্ছা নেই।’ 

ইরানের আঞ্চলিক নীতি বা কৌশল সিরিয়ার মধ্যে সীমিত নয়- তাদের এই নীতি লেবানন থেকে ইয়েমেন এবং উপসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। কুর্দি প্রদেশের বাইরে সার্বিকভাবে ইরাকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে এবং আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে- তা পূরণ করে তেহরানের নীতি হলো, ওই অঞ্চলে সৌদি এবং উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর যেকোনো প্রভাব বা বাইরের চেহারা বর্জন করা। সংক্ষেপে বলতে হয়, আগামী দিনে ইরানের লক্ষ্য হচ্ছে, যেকোনো প্রভাবশালী আরব জাগরণকে দুর্বল করা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইরানি নেতৃত্ব এখন নিজেদের অনেক শক্তিশালী ও অধিকতর আস্থাশীল বলে মনে করে।

স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে, ইরান অথবা হিজবুল্লাহর কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে না। ইরান বা হিজবুল্লাহর কাছ থেকে তাদের স্বার্থের ওপর আর কোনো হুমকি আসবে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না। 
এটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য-নীতির একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ওয়াশিংটনের আচার আচরণের মাধ্যমে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের পরাশক্তি; কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এটা সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বিদেশে সঙ্ঘাত বা যুদ্ধ করার অথবা আরববিশ্ব দখলের কোনো ইচ্ছা তার দেশের নেই। 

আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় ব্যয়বহুল যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার জনগণের বর্তমান মানসিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ওবামা সত্যিকার অর্থে আমাদের একটি সুপার পাওয়ারের সীমাবদ্ধতা দেখিয়েছেন। চলতি বছরের প্রথমার্ধে আটলান্টিক ম্যাগাজিনে তার সাক্ষাৎকারে কিছুটা স্পষ্ট করে এই বিষয়টার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারে ওবামা বলেন, ‘আমি যা চিন্তা করি, তা তীক্ষ্ণ ও বুদ্ধিভিত্তিক নয়। সব সময় সেখানে একটা সমস্যা হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। শৃঙ্খলাবিধান বা নির্দেশ পালন করার জন্য আমরা সেনাবাহিনী পাঠিয়ে থাকি। আমরা সঠিক ও ন্যায়সঙ্গতভাবে তা করতে পারছি না।’ ওবামার এই বক্তব্য মাথায় রেখে আমেরিকার শূন্যস্থান পূরণ করতে পুতিন কঠোরভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

লেখক : লন্ডনের ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের একজন সাবেক সভাপতি।

গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement
আবারো চেন্নাইয়ের হার, ম্লান মোস্তাফিজ 'কেএনএফ' সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা অর্থনীতিতে চুরি : ব্যাংকে ডাকাতি পাকিস্তানে আফগান তালেবান আলেম নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না করলে এ বছরই রাশিয়ার কাছে হারতে পারে ইউক্রেন : সিআইএ প্রধান রাশিয়ার সামরিক শিল্পক্ষেত্রে প্রধান যোগানদার চীন : ব্লিংকন ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে 'বিকট বিস্ফোরণ' শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির মৃত্যু নীলফামারীতে তিন হাজার ১৭০ চাষির মাঝে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ

সকল