২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ইরাককে কেন ভেঙে ফেলতে চায় ইসরাইল?

ইরাক
আইএসের বিরুদ্ধে ইরাকের সরকারি বাহিনীর অবস্থান - ছবি: সংগৃহীত

ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার দাবিকে পূর্ণ সমর্থন করছে বিশ্বের একটি মাত্র দেশ ইসরাইল। সম্প্রতি কুর্দিস্তানে অনুষ্ঠিত গণভোটের সময় ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কুর্দিদের প্রতি সমর্থনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। ইসরাইলের এই অবস্থানের নেপথ্যে রয়েছে সুদূরপ্রসারী ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ।

ইসরাইলের এ অবস্থান যতটা না কুর্দিদের স্বার্থে তার চেয়েও বেশি নিজেদের স্বার্থে। মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বে ভাঙন আর নিজেদের অনুগত একটি দেশ সৃষ্টিই ইসরাইলের মূল লক্ষ্য। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ও সামরিক কারণগুলো তো রয়েছেই।

মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দি জনগোষ্ঠীর প্রতি ইসরাইলের এই দরদ নতুন নয়। কয়েক দশক ধরে ওই জনগোষ্ঠীটির সাথে ইসরাইলের রয়েছে আন্তরিক সম্পর্ক। গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময় ও পরবর্তী সময়ে নিহিত দুই অঞ্চলের সম্পর্কের শেকড়। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক কুর্দি ইহুদি সেখানে গিয়ে বসতি গড়লেও তারা কুর্দিস্তানের আত্মীয়স্বজনদের সাথে নিয়মিতই যোগাযোগ রাখতেন। সেই থেকেই কুর্দিদের সাথে তেল আবিবের সম্পর্কের সূত্রপাত। পরে যা আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে শত্রুতার কারণে ইসরাইল সব সময়ই চাইতো ওই অঞ্চলে কোনো অ-আরব মিত্র। এ জন্য তারা বেছে নেয় বিভিন্ন দেশে বিভক্ত হয়ে পড়া কুর্দিদের। জাতিগত বিভক্তি উসকে দিতে শুরু করে এ অঞ্চলে। একঘরে অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে এই কৌশলটি নিয়েছিলেন ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান। সেই সূত্রেই কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানির পিতা মুস্তফা বারজানির সাথে সম্পর্ক ছিল তেল আবিবের। ১৯৬৮ ও ৭৩ সালে দুই দফায় ইসরাইল সফরও করেছেন মুস্তফা। বর্তমান সময়েও ইসরাইলি লিকুদ পার্টির সরকার সেই একই নীতিতে চলছে।

ইহুদিবাদী দেশটি চায় আঞ্চলিক বৈরী দেশগুলোর বিপরীতে নতুন কোনো মিত্র দেশ। যেটি একই সাথে তাদের মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারেও হাতিয়ার হবে। আরব বিশ্বে ভাঙন ধরাতে পারলে তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ইসরাইল। আর কুর্দিস্তান স্বাধীন হলে সেটি যে ইসরাইলের মিত্র হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একই সাথে এই ভূখণ্ডটি হবে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ও তাদের গোয়েন্দাদের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র।

ভৌগোলিক দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দিস্তানের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অঞ্চলটির চার দিকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ- ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরান। এমন একটি জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে এই দেশগুলোকে মোকাবেলায় অনেকটাই এগিয়ে যাবে ইসরাইল। কাজেই আরববিশ্বে জাতিগত বিভক্তি ও নিজেদের মিত্র পাওয়ার এমন সুযোগ তারা ছাড়তে চাইছে না। এ অঞ্চলটির ব্যাপক অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। কুর্দিস্তানের রয়েছে অঢেল তেলসম্পদ। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল না পেলেও ইসরাইলের আমদানিকৃত তেলসম্পদের ৭৭ শতাংশই কুর্দি অঞ্চল থেকে আনে। দেশটি স্বাধীন হলে ইসরাইলের জন্য তা আরো নিরাপদ বাণিজ্যকেন্দ্র হবে।

কুর্দিরাও তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আর কোনো সাহায্য না পেয়ে ইসরাইলের দিকে ঝুঁকতে পারে। সিএনএন’র বিশ্লেষক ইয়ান লি তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, কুর্দিদের চার দিকে সম্ভাব্য শত্রু। এমনকি তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও গণভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু একমাত্র আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইসরাইল তাদের সমর্থন দিয়েছে। এই বিশ্লেষক মনে করেন, এ কারণেই কুর্দিরা স্বাধীনতা পেতে ইসরাইলের সাহায্য চাইতে পারে।

কুর্দিরা ব্যক্তিপর্যায়েও ইসরাইলের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো জাতি বা দেশের লোকদের চেয়ে আন্তরিক। লিকুদ পার্টির সাবেক মন্ত্রী গিডেওন সা’র মনে করতেন মধ্যপ্রাচে দুটি জাতি অবহেলিত, তাদের মধ্যে ইহুদিরা রাষ্ট্র পেলেও কুর্দিরা পায়নি। তিনি বলতেন, ‘কুর্দিরা হলো ইসরাইলের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও দীর্ঘস্থায়ী মিত্র’। কুর্দিস্তানের গণভোটের সময় আঞ্চলিক রাজধানী ইরবিলে ইসরাইলি পতাকা উড়ানোর কথা এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। কেউ কেউ ‘আমরা হবো নতুন ইসরাইল’ এমন স্লোগানও দিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

কুর্দিস্তানের প্রতি ইসরাইলের এই সমর্থন যে কুর্দিদের প্রতিবেশী দেশগুলোর অগোচরে হচ্ছে তা নয়, তারা সব কিছু সম্পর্কেই অবগত আছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে মাসুদ বারজানিকে নেতানিয়াহুর পুতুল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তুরস্ক তো সরাসরিই বলেছে, ইসরাইলি গোয়েন্দারা তুর্কিদের স্বাধীনতার বিষয়ে সহযোগিতা করছে। কামাল আতাতুর্কের সময় থেকে তুরস্কের সাথে ইসরাইলের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও এই ইস্যুতে যে রজব তাইয়্যেব এরদোগানের সরকার ছেড়ে কথা বলবে না তা বোঝাই যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এরদোগান সম্প্রতি ইরান সফর করেছেন।

ইরানি নেতাদের সাথে আলোচনার মূল বিষয় ছিল কুর্দি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণ করা। কাজেই এরকম বৈরিতার মুখে ইসরাইলের ভূমিকা কেমন হবে তা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই সঙ্কটের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে সে বিষয়ে আলজাজিরার মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার লামিস অ্যানডোনি বলেন, কুর্দি ও আরবদের ভাঙন ঠেকানোর সময় পার হয়ে যায়নি। এই অঞ্চলে ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা ঠেকানো জরুরি; কিন্তু (সেটি করতে গিয়ে) আরব ও কুর্দিদের পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করা হবে ভুল ও আত্মঘাতী। ‘কুর্দিস্তান দ্বিতীয় ইসরাইল হবে’ এমন সব স্লোগান এখনই বন্ধ করতে হবে।

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement

সকল