২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ পরিকল্পনা!

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ পরিকল্পনা! - সংগৃহীত

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ভৌগোলিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনার জন্য কয়েকটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ভৌগোলিক সীমানায় গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত ১৩তম ভৌগোলিক সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিন পরিকল্পনার নানা দিক তুলে ধরতে গিয়ে জেনারেল আমির হাতামি এ কথা বলেছেন।

তিনি বলেন, সাইক্স পিকো' পাশ্চাত্যের এমন একটি চুক্তি বা পরিকল্পনা যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে দখলদারত্ব, সম্প্রসারণকামিতা ও উপনিবেশবাদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করার মার্কিন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে আরো বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও শোষণের প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা করেছে আমেরিকা।

২০১৩ সালের শেষের দিকে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, পাঁচটি আরব দেশকে ভেঙে ১৪টি ছোট ছোট দেশ গঠন করা হবে।

কেমন আছে মধ্যপ্রাচ্য : একটি মূল্যায়ন
মাসুম বিল্লাহ

মিডল ইস্ট বা বাংলায় আমরা বিশ্বের যে অঞ্চলটিকে মধ্যপ্রাচ্য হিসেবে চিনি তা যেন ইলাস্টিকের মতো সম্প্রসারণশীল। ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অঞ্চলটির এই নাম দেয়। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশের অধীন এলাকাগুলোকে ভাগ করতে গিয়ে ব্রিটেনের আশপাশ এবং উত্তর আফ্রিকার বেশির ভাগ অঞ্চলকে নিকটপ্রাচ্য, ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব দিকের দেশগুলোকে দূরপ্রাচ্য এবং ব্রিটিশ ভারত ও নিকটপ্রাচ্যের মধ্যবর্তী এলাকাকে মধ্যপ্রাচ্য নামকরণ করে।

পরবর্তী সময়ে এ নামেই দীর্ঘ দিন ধরে অঞ্চলগুলো পরিচিত হতে থাকে। শুধু ব্রিটিশরাই নয়, অন্যান্য বিশ্বশক্তিও এই নাম গ্রহণ করে নিজ নিজ নীতি ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে এগিয়ে যায়। বর্তমানে উত্তর আফ্রিকার উপকূল থেকে আফগানিস্তানের পশ্চিম ভাগ পর্যন্ত মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে তুরস্ক ও ইরানকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয়ভাবে মুসলমান এবং জাতিগতভাবে আরব। বিংশ শতকের প্রথম ও মধ্যভাগে এসব অঞ্চলে নতুন নতুন রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এগুলো ইউরোপের জাতি-রাষ্ট্রের আদলে সৃষ্ট।

পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যে দু’টি ফল্ট লাইন বা বিভক্তি রেখা তৈরি হয়। এর একটি ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এবং ইসলামের মধ্যে। স্নায়ুযুদ্ধ এই বিভক্তি রেখাকে আরো প্রশস্ত করে। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ অঞ্চলের সাথে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়ায়। ফলে এ অঞ্চলের একটি অংশ সেকুলার ও সোশ্যালিস্ট আদর্শ অনুসরণ করে সামরিক শক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আরেকটি অংশ বিশেষ করে আরব উপদ্বীপ হয় ইসলামপন্থী, ঐতিহ্যপন্থী ও রাজতন্ত্রের অনুসারী। শেষের ভাগটি সাধারণভাবে পশ্চিমাপন্থী এবং পূর্বতনটি হয় সোভিয়েতপন্থী। যদিও এখন এই বিভক্তি রেখাটি বর্ণনার মতো তত সহজ নয়, কিন্তু এটি আমাদেরকে এ অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সহায়তা করে।

দ্বিতীয় বিভক্তি রেখাটি রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যেই যা এ অঞ্চলের বাস্তবতার প্রতিফলন। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো সাধারণভাবে বিংশ শতকের জাতিরাষ্ট্রের সংজ্ঞার ভিত্তিতে নিজেদের দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইউরোপীয়দের দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট রাষ্ট্রগুলো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এখানে নিম্ন ও উচ্চপর্যায়ে ভিন্নতা দেখা দেয়। নিম্নপর্যায়ে ছিল বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী, এবং জাতিগত সম্প্রদায়।

রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এরা আবার নিজেদের চিহ্নিত সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত ছিল। আর উচ্চপর্যায়ে ইসলাম এবং ইসলামের বিভিন্ন চিন্তাধারার প্রতি আনুগত্য, শিয়া বা সুন্নি ইত্যাদি। এসব বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় তথা কোনো রাষ্ট্রীয় সীমারেখায় তা আবদ্ধ নয়। এর সাথে যুক্ত হয় মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের প্যান-আরব আন্দোলন। যার কথা ছিল আরব দেশগুলোকে একটি মাত্র রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। 

মধ্যপ্রাচ্যকে বুঝতে হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক ভূগোল ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ভিন্ন মাত্রার সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয় সেখানে বৃহত্তর আঞ্চলিক ও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর কর্তৃত্ব সীমিত করার প্রচেষ্টা চলে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্রগুলোর কোনটি সেকুলারিজম আবার কোনটি ট্র্যাডিশনালিজমকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে।

একে গোষ্ঠীগত চেতনা মোকাবেলার পাশাপাশি বৃহত্তর ধর্মীয় বিশ্বাসের দাবিদার হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি ক্ষেত্র ছিল ইসরাইল। এ অঞ্চলের প্রতিটি রাষ্ট্র যার বিরোধিতা করে। যদিও এই বিরোধিতায় বাস্তবতার চেয়ে কল্পনাই ছিল বেশি। মিসর ও সিরিয়ার মতো সেকুলার সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে ইসরাইলের বিরোধিতায় নামে। অন্য দিকে সোশ্যালিস্টদের হুমকি মনে করা রাজতন্ত্রের অনুসারী রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলকে দেখতে পায় মিত্র হিসেবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং মধ্যপ্রাচ্যের সেকুলার সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্রগুলো এর সমর্থন হারানোর পর ঐতিহ্যগত রাজতন্ত্রপন্থী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এখানে কেবল আর্থিক সহায়তার প্রশ্নই ছিল না, ছিল মূল্যবোধের প্রশ্নও। সেকুলার সোশ্যালিস্ট আন্দোলন পৃষ্ঠপোষকতা হারানোর পাশাপাাশি বিশ্বাসযোগ্যতাও হারায়। সোশ্যালিস্ট সেকুলার-ভিত্তিক সংগঠন ফাতাহর মতো আন্দোলনগুলো, কেবল ইসলামি মূল্যবোধ ধারণ করে বেড়ে ওঠা আন্দোলনগুলোর তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়ে।

এই প্রক্রিয়ায় প্রচণ্ড রকম টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। সেকুলার সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্রগুলো প্রাণপণ চেষ্টা চালায় টিকে থাকার জন্য। মিসরের হোসনি মোবারক, সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মতো শাসকেরা তখনো টিকে ছিলেন। এসব শাসকের বিরুদ্ধে দুর্নীতিপরায়ণতার অভিযোগ থাকলেও সেকুলার সোশ্যালিস্ট আন্দোলনের আবেদন ছিল এসব দেশে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের সাথে সাথে এসব আন্দোলনও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়ে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ইসলামপন্থী দলগুলোকে শক্তিশালী করে। এক দিকে যেমন মুজাহিদরা আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের পরাজিত করে তেমনি ইসলামি চিন্তাধারার বিকল্পগুলো কার্যকারিতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের দিনগুলোতেই ইরাকের কুয়েত অভিযান চালালোর ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ কূটনীতির ফলে এ দু’টি দেশেরই জন্ম। এ অঞ্চলে ব্রিটেনের ভূমিকা নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা ব্রিটেনের আরেক সৃষ্ট সৌদি আরবকে রক্ষায় এগিয়ে আসে এবং কুয়েতকে মুক্ত করে ইরাকের কবল থেকে।

পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে এসব কাজ দরকার ছিল এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য। কোনো আঞ্চলিক আধিপত্যবাদীকে যদি বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। তাই আরব বিশ্বে সোভিয়েতবিরোধী দেশগুলোর সাথে জোট করে ‘ডেজার্ট স্টর্ম’ অভিযান পরিচালনা ছিল সাধারণ এবং একটি যৌক্তিক পরিণতি। 


আরো সংবাদ



premium cement