২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফিলিস্তিনিদের ক্যামেরা যুদ্ধ

এক হাতে বাবার ক্যামেরা ও অন্য হাতে ইসরাইলি সেনাদের নষ্ট করা ফোন নিয়ে ১৪ বছর বয়সী আমির জাবের - ছবি : এএফপ

২ জুন ২০১৮। ফিলিস্তিনের হেবরন শহরের পশ্চিম তীরের দক্ষিণাঞ্চলে ইব্রাহিমি মসজিদের পাশে ৩৭ বছর বয়সী নির্মাণকর্মী রামি ওয়াহিদ সাবারনেহকে গুলি করে হত্যা করে ইসরাইলি সেনারা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন হেবরনভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্সের (এইচআরডি) সদস্য আরেফ জাবের। তিনি পুরো ঘটনাটি রেকর্ড করে রেখেছিলেন তার ক্যামেরায়। এক সৈন্য জাবেরকে দেখতে পেয়ে তাকে ভিডিওটি ডিলিট করে দিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু জাবের তাতে রাজি না হলে ওই সেনা তার মাথায় বন্দুক ধরে হত্যার হুমকি দেয়। 

এর আগেও ২০১৬ সালে ২০ বছর বয়সী আবদুল ফাত্তাহ আল শরিফকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিল এলোর আজারিয়া নামে এক ইসরাইলি সেনা। আরেক সেনার হামলায় আবদুল ফাত্তাহ আহত হয়ে পড়েছিলেন। সে সময়ই আজারিয়া তাকে হত্যা করে। সে সময় এইচআরডির আরেক সদস্য আবু শামসিয়াহ ঘটনাটির ভিডিও করে পাঠিয়ে দেন মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে। ভিডিও প্রকাশের ছয় ঘণ্টা পরে তার বাসায় ছুটে আসে ইসরাইলি সেনারা। ওই ভিডিও করার দায়ে তাকে ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের মৌখিক ও শারীরিকভাবে চরম হেনস্তা করে সেনারা। তার বাসায় ককটেল হামলা হয়। আবু শামসিয়ার ছেলেকে রাস্তায় হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। এমনকি ওই ভিডিওর জেরে এলোরকে আদালতে তোলা হলে এ বিষয়ে ভিন্ন মতামত দেয়ার জন্যও প্রচুর চাপ দেয়া হয় আবু শামসিয়াকে। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত এলোরকে কারাগারে যেতে হয়। আবু শামসিয়াহ বলেন, যদি ওই ভিডিওটি না থাকত, তাহলে আজারিয়াকে কিছুতেই শাস্তির মুখোমুখি করা যেত না। নগণ্য হলেও এলোরকে শাস্তির মুখোমুখি করতে পারায় তার আত্মবিশ্বাস এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তিনি ও তার স্ত্রী ক্যামেরা নিয়ে এখনো কাজ করেন। সেই সাথে তাদের শিশুসন্তানদেরও এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ইসরাইলি সৈন্যদের হাতে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের হত্যার ব্যাপারটি তাদের কাছে মামুলি হয়ে দাঁড়ালেও এসব ভিডিওর কারণে মাঝেমধ্যেই তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেই সাথে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।

ক্যামেরা ঠেকাতে আইন
এসব বিচার ও সমালোচনা এড়াতে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এবার ‘কর্তব্যরত’ ইসরাইলি সেনাদের ছবি ও ভিডিও তোলার বিষয়টি নিষিদ্ধ করতে আইন পাস করতে যাচ্ছে। বিল অনুসারে, ইসরাইলি সেনাদের মনোবলবিরোধী কোনো ছবি, ভিডিও ইত্যাদি করা হলে বা সেনাদের কার্যক্রমে ঝামেলা করার বিষয়টি প্রমাণিত হলে পাঁচ বছর এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হলে ১০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিন ও ইসরাইলসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিলের নিন্দা জানিয়েছে। তারা জানায়, আইনটি পাস হলে তা হবে ইসরাইলি সেনাদের এ ধরনের নৃশংস কর্মকাণ্ড আরো অবাধে চালানোর নিশ্চয়তা প্রদান।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজেও গত রোববার দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাভিচাই ম্যানডেলব্লিটের বরাত দিয়ে জানায়, ‘আইনটি সাংবিধানিক দিক থেকে সমস্যাযুক্ত।’ দেশটির মন্ত্রিসভা ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে। তবে বিলটি পাস করতে এখনো কয়েকটি ধাপ বাকি রয়েছে। আইনটির প্রণেতা কমিটি অবশ্য বলছে, পাসের আগে এতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হবে। ফিলিস্তিনিরা অবশ্য এ আশ্বাসে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। 

এইচআরডির সহপ্রতিষ্ঠাতা বাদি ডিউইক বলেন, ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম পর্যায়ে তারা যে বিলটি উত্থাপন করেছে, সেটিকে তারা খুবই বিপজ্জনক বলে মনে করছে। এখনো তারা বিলটি পাস করেনি, কিন্তু আমরা এখনই হেবরনে বসে এর প্রতিক্রিয়া টের পাচ্ছি। তিনি বলেন, গত মাসেই কাজ করার সময় এইচআরডির এক-তৃতীয়াংশ সদস্য ইসরাইলি সেনা কর্তৃক মৌখিক ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছে।
ক্যামেরা মিথ্যে বলে না 

হেবরনের পুরনো শহরে ৮০০ ইহুদি বসতি রয়েছে। তাদের নিরাপত্তায় রয়েছে সহস্রাধিক সেনাসদস্য ও ২০টি সেনাচৌকি। ১৯৯৪ সালে ইব্রাহিমি মসজিদে গণহত্যা চালানোর পর শহরটি ফিলিস্তিন নিয়ন্ত্রিত (এইচ-১) ও ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত (এইচ-২) এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নির্যাতন চালায় তার প্রমাণ সংগ্রহ করতেই এ শহরে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এইচআরডি। ২০১৫ সাল থেকে তারা ক্যামেরা প্রজেক্ট চালু করে। ইতোমধ্যে ১০টি পরিবারকে ক্যামেরা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরো ৩০ জন শিশুকেও তারা এ কাজে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। তারা এ ক্ষেত্রে শিশুদের নিরাপদ স্থানে থেকে এসব ভিডিও ধারণ করতে এবং আইনি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। 
বাদি ডিউইক বলেন, ক্যামেরা কখনো মিথ্যা বলে না। এটি কেবল সত্যকেই প্রতিফলিত করতে পারে। আর এটিকে একটি শান্তিপূর্ণ অস্ত্র হিসেবেই আমরা ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছি। 
হুমকি, হামলা ও গ্রেফতার
আবু শামসিয়ার ওপর ইসরাইলি সেনারা যে নিপীড়ন চালিয়েছিল, তা অবশ্য নতুন কোনো কিছু ছিল না সে বা তার পরিবারের কাছে। এ পর্যন্ত এইচআরডির প্রায় সব সদস্যই ইসরাইলি সেনাদের মৌখিক ও শারীরিক হামলার শিকার হয়েছে। ক্যামেরা-মোবাইল নিয়ে যাওয়া ও ভেঙে ফেলা, গ্রেফতার ও গ্রেফতারের হুমকি, রিমান্ড, প্রহার ককটেল হামলা ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যার শিকার হন তারা প্রায়ই। এত কিছুর পরও তারা উৎফুল্ল ছিলেন এই ভেবে যে, তাদের এসব কাজের কারণে ইসরাইলি সেনারা কী পরিমাণ ভয় পাচ্ছে। তবে নতুন এই বিলের বিষয়ে তারা খুবই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। 

আইনের কঠোরতা নিয়ে ভয়
যদিও আইনের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, এটি কেবল কর্তব্যরত সেনাদের ভিডিও বা ছবি তোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, অন্যক্ষেত্রে আগের মতোই চলতে থাকবে, কিন্তু ডিউইক, জাবের বা আবু শামসিয়ারা মনে করছেন, বিলে যে দিকগুলো অস্পষ্ট রাখা হয়েছে, সেগুলোই সেনাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টিকে ঢেকে দেবে। কারণ ‘সেনাদের কাজে হস্তক্ষেপ’ বলতে এখানে আসলে কী বুঝানো হচ্ছে? এর অর্থ হচ্ছে, সেনা যা-ই করতে ইচ্ছা করুক না কেন। আর এ কারণেই বিলটি এত বিপজ্জনক। ডিউইক বলেন, যদি আমরা এ কাজগুলো না করি, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিভাবে জানবে এখানে কী হচ্ছে? জাবের বলেন, ইসরাইলি সেনাদের কাছে অস্ত্র আছে, তারা বলে এগুলো দিয়ে তারা তাদের লোকজনকে রক্ষা করছে। কিন্তু আমাদের হাতে অস্ত্র নেই, আছে শুধু ক্যামেরা। আমরা আমাদের লোকজনকে রক্ষা করতে এ ক্যামেরাই ব্যবহার করে থাকি। 

বিটিসালেম নামে আরেকটি মানবাধিকার সংস্থাও এ বিলের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এটি আইনের কঠোরতম একটি অংশ। তারা মন্তব্য করে, যদি ইসরাইল সরকার মনে করে, এ বিষয়টি বিব্রতকর, তাহলে তারা যা চালাচ্ছে তা বন্ধ করা দরকার, ফটোগ্রাফারদের নয়। তারা এ-ও জানায়, এই ভিডিও নেয়া ও প্রমাণ তৈরির কাজ অব্যাহত থাকবে। 
সূত্র : মিডলইস্ট আই


আরো সংবাদ



premium cement