২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পর্যটনে ঝুঁকছে ওমান

-

মাসকাট বিমানবন্দরে নেমে ডলার ভাঙাতে গিয়ে তো মাথায় হাত। সাধারণত যেকোনো দেশের বিমানবন্দরে নেমে ১০০ ডলারের বেশি ভাঙাই না। বিমানবন্দরে ডলারের বিনিময় মূল্য হিসেবে সে দেশের মুদ্রা কম পাওয়া যায়; যা বাইরে বেশি। এর পরও উপায় থাকে না বলেই এই কাজ করা। কিন্তু ওমানের মাটিতে নেমে ডলারের সাথে ওমানি মুদ্রা রিয়ালের বিনিময় করতে গিতে রীতিমতো বিস্মিত। আমাকে বলা হলো ১০০ ডলারের বিপরীতে পাবেন ৩৫ রিয়াল। মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে ফুটবলপ্রিয় কর্মচারীটির এই কথায় আমি হিসাব মেলাতে পারছিলাম না। হাতে যে কয়েক শ’ ডলার আছে এই দিয়ে তো দেখি ১০০ রিয়ালও জুটবে না। আমার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ চোখে পড়ল ওই কর্মচারীর। তারা এই ধরনের দৃশ্যের সাথে পরিচিত বলেই মনে হলো। সাথে সাথে সে আমাকে জানিয়ে দিলো ওমানের মুদ্রা বিশ্বের চতুর্থ উচ্চ মূল্যের। এরপর আমাকে জানিয়ে দিলো বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আমার নির্দিষ্ট স্থানে যেতে ২০ রিয়াল ভাড়া দিতে হবে। তার এই তথ্যে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম।
যাই হোক, এর পরও ১০০ ডলারের বেশি আর ভাঙালাম না। অবশ্য আমাকে মুদ্রাবিনিময় করা এই কর্মচারী বুদ্ধি দিলো ট্যাক্সিতে না চড়ে বাসে যাওয়ার জন্য। তা হলে এক রিয়ালের বেশি খরচ পড়বে না। বাসের ব্যবস্থার কথাও জানালেন তিনি। মাঝ রাতে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে বাস পেয়েও গেলাম নিচতলা যাওয়ার পর। সেখানে আগ থেকে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ দুই বাংলাদেশীর সহযোগিতায় রওনা হলাম। বাস ভাড়া অবশ্য কম। ভোরে বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে আমাদের নামিয়ে দিলো। ভোর হওয়ায় বাসস্ট্যান্ডে থাকা মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে ওই বাংলাদেশীদের সহযোগিতায় দুই রিয়াল চুক্তিতে ট্যাক্সিতে উঠলাম। অবশ্য না চেনার ভান করে ট্যাক্সি ড্রাইভার পাঁচ রিয়াল নিয়ে ছাড়ল আমার কাছ থেকে। আমি অবশ্য তাকে সঠিক তথ্যই দিয়েছিলাম। যাই হোক শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশী অন্য সাংবাদিকদের অবস্থানস্থল হোটেল ওয়েসিস অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিলো সে।
ততক্ষণে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ওমানের উন্নতি আর প্রাচুর্য জানা হয়ে গেল। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশের মতোই উন্নত ওমান। তবে ওই অঞ্চলের নোংরা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় ওমান। আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে তারা বেশ দূরে; যে কারণে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ওমানকে নিয়ে কম নিউজই আসে। যেমনটি বেশি পাওয়া যায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আবর, ইরাক, জর্দান, সিরিয়া ও ইয়েমেনকে ঘিরে। নিজেদের আরব বিশ্বের রাজনীতির বাইরে রেখেছে ওমান। সবার সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক।
তবে তেলের দাম কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে যায় ওমানের। তেলনির্ভর আরব দেশগুলোর অবস্থা এ রকমই। তেলের দাম বাড়লে মহাখুশি। আর পতন হলেই মাথায় হাত। তাই আয়ের উৎস হিসেবে তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে এখন পর্যটন শিল্পের দিকে ঝুঁকছে ওমান। শীতকালে ওমানে সহনীয় আবহাওয়া, যা কল্পনাও করা যায় না গরমের সময়। শীতে ইউরোপের দেশগুলোতে তাপমাত্রা মাইনাসে চলে যায়। বরফে আচ্ছাদিত হয়ে যায় সব। তখন ইউরোপিয়ানরা ভ্রমণ করতে বের হন। ওমানও তাদের ভ্রমণের অন্যতম স্থান। বিশ্বকাপ ফুটবল বাছাইয়ে ওমান ও বাংলাদেশ দলের ম্যাচ কভার করতে ওমান গিয়ে পেলাম বহু ইউরোপিয়ানকে। তারা দল বেঁধে ঘুরছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থানে। মৌসুমে লাখ লাখ বিদেশী এই দেশটিতে আসেন ভ্রমণ করতে। এই পর্যটন এখন ওমানের আয়ের অন্যতম উৎস। সেখানকার বাংলাদেশীরা জানালেন, তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পর ওমান এখন তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে পর্যটনের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া কিছু শিল্পকারখানাও প্রতিষ্ঠা করছে। বেশ কিছু সিমেন্টের কারখানা আছে। কৃষিতেও জোর দিয়েছে তারা। ওমানের সেরা পর্যটন স্পটের মধ্যে আছে মিসফাত আল আবরাইন, মাসিরা দ্বীপ, বাহলা, সালালা, জেবেল আখদার, রাজ আল জিনজ, মুসানদাম জোর্দ, ওয়াহিবা মরুভূমি, নিজওয়া এবং সমুদ্র তীরবর্তী শহর মাসকাট। গত ১০ জানুয়ারি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া সুলতান খাবুসের যে বাসভবন, তা রাজধানী মাসকাটে সাগর তীরবর্তী।
ওমানের জনগণ ভালোই ইংরেজি জানেন। ওমানিরাই বিদেশী পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করেন। মেয়েরা ব্যাংকে চাকরি করছেন। এ ছাড়া দেশটিতে প্রচুর বিদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ছাড়াও আফ্রিকান দেশগুলোর বহু শ্রমিক। তবে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীতে কোনো বিদেশী নেই। সবাই খাঁটি ওমানি। ওমানে যত ট্যাক্সি ড্রাইভার আছেন তারাও চমৎকার ইংরেজি জানেন। এই ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সবাই ওমানি। বাইরের কোনো লোক ট্যাক্সি চালাতে পারবেন না। এটা স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের জন্যই। এখন বিভিন্ন পেশায় ওমানিদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তা তাদের কর্মসংস্থানের অংশ হিসেবেই।
চুরি চামারির ঘটনা কমই ওমানে। অবশ্য এর পরও সামান্য যা কিছু চুরি হয় তা পাকিস্তানিদের কারণে। এ জন্য তাদের শাস্তিও হয়। জানান বাংলাদেশীরা।
৪৯ বছর ধরে ওমানের শাসক ছিলেন সুলতান খাবুস বিন সাঈদ। তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। অনেকেই তাকে বাবা খাবুস নামে ডাকেন। মূলত তিনিই ওমানিদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন। আধুনিক ওমানের রূপকার। বাংলাদেশী সাগর জানালেন, পাঁচ বছর খাবুস দেশে ছিলেন না। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে যান। এই খবর কেউই জানতেন না। হঠাৎ এক দিন দেখা গেল মাসকাট শহরে ব্যাপক লাইটিং, পোস্টারিং। এরপর মানুষদের ভূরিভোজ করানো হচ্ছে। তখন জানা গেল এটা সুলতানের সুস্থ হয়ে দেশে ফেরা উপলক্ষে। তখনই সর্বসাধারণ জানতে পেরেছেন সুলতান অসুস্থ হয়েছেন এবং দেশের বাইরে ছিলেন। অবশ্য সুলতানের ফেরা উপলক্ষে ওই ব্যাপক আয়োজনের যে নেপথ্য নায়ক ছিলেন, সুলতান দেশে ফিরেই তাকে বহিষ্কার করেন। সুলতানের বক্তব্য ছিল, জনগণের টাকায় কে তাকে এই আয়োজন করে অর্থ অপচয় করার অনুমতি দিয়েছে।
ওমানের তিনটি মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানে নামাজের জামাতে শোনা গেল প্রতি রাকাতে দু’টি সূরা পড়ার আগে ইমাম সাহেবকে জোরে বিসমিল্লাহ বলতে। ওমানে প্রচুর ইয়েমেনির বাস। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত এই দেশ ওমানের ইন্তেকাল করা সুলতানের নানার বাড়ি। তাই ইয়েমেন থেকে যুদ্ধের কারণে ওমানে আশ্রয় নেয়াদের থাকা-খাওয়া ফ্রি করে দিয়েছেন সুলতান খাবুস। জানান প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
দেশটির জনগণের মধ্যে ইসলামী ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়েছে। রাস্তায় যেসব মহিলাকে চোখে পড়েছে, তাদের বেশির ভাগই হিজাব পরা। স্থানীয়দের আচরণও ভালো। এই ওমানের মাটিতে শুয়ে আছেন তিনজন নবী। তাঁরা হলেন হজরত ইদ্রিস আ:, হজরত ইউনুস আ: ও হজরত আইয়ুব আ:। হজরত ঈসা আ:-এর নানা মরিয়মের বাবা ইমরানের কবরও ওমানে। অবশ্য এদের সবার কবরই ওমানের দক্ষিণের শহর সালালাতে। সমুদ্রতীরবর্তী এই শহর রাজধানী মাসকাট থেকে এক ঘণ্টা বিমান ভ্রমণের পথ। বাসে প্রায় ১৬ ঘণ্টা। সালালাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এখানকার পরিবেশ চমৎকার। সবুজ গাছগাছালিতে আবৃত এই শহরটি, যা ওমানের দ্বিতীয় রাজধানী নামেও পরিচিত। ওখানে সুলতান খাবুস সেখানে দ্বিতীয় বাড়ি বানিয়েছেন।
ওমানে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। বিশেষ করে প্রবাসীদের। তারা নিজ দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারে না। আগে এসব কর্মসূচি তারা পালন করত। কিন্তু পরে ওমান সরকার তা বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশীরা চার-পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ওমান শাখার ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারে না। জানিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছিল এই দেশটিতে। পরে সুলতান তা সামলিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, মাসকাটসহ অন্য স্থানে কিছু ভারতীয় প্রতারক আছে। এরা লোক বুঝে টার্গেট করে। একটু মোটাসোটা হলে তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বোঝানো হয় আপনি অসুস্থ। আমি আপনার মতো ছিলাম। কিন্তু এই ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে গেছি। এই বলে তারা টার্গেটকৃত লোকের কাছে ওষুধ বিক্রি করেন। জানান স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশীরা। ওমানে এখন মেট্রোরেল চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালুরও প্রক্রিয়া চলছে।  


আরো সংবাদ



premium cement
আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত

সকল