২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
কাজে আসেনি ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা

দুর্নীতির সূচকে একই অবস্থা বাংলাদেশের

টিআইবির সংবাদ সম্মেলন : নয়া দিগন্ত -

দেশের নাগরিকদের জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে সরকার। তবে এই স্লেøাগান দুর্নীতি রোধে উল্লেখ যোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সম্প্রতি দুর্নীতির ধারণাসূচক বা করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সিপিআই) অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। ১০০ নম্বরের মানদণ্ডে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। ২০১৮ সালেও একই স্কোর ছিল। বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ২০১৯ সালের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এ সূচক প্রকাশ করে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
টিআই প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় সিপিআই-২০১৯ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয় এমন দেশের মধ্যে যৌথভাবে শীর্ষ রয়েছে ইউরোপের দেশ ডেনমার্ক এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দেশ নিউজিল্যান্ড। দুর্নীতির সূচকে শূন্য (০) স্কোরধারী দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ এবং ১০০ স্কোরধারী দেশ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এবার ডেনমার্কের স্কোর ৮৭ এবং নিউজিল্যান্ডের ৮৭। ২০১৮ সালেও এ দু’টি দেশ শীর্ষ স্থানে ছিল। ওই বছর ডেনমার্কের স্কোর ৮৮ ছিল এবং নিউজিল্যান্ডসের ৮৭। ৮৬ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে একই স্কোর ৮৫ নিয়ে যৌথভাবে সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড।
টিআই কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই) ২০১৯ সালে ০-১০০ স্কেলে গতবারের সমান ২৬ স্কোর পেয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম, যা ২০১৮ এর তুলনায় ১ ধাপ উন্নতি এবং সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী ১৪৬তম, যা ২০১৮ এর তুলনায় ৩ ধাপ উন্নতি। এবার সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থানের খানিকটা উন্নতি হলেও স্কোর গতবারের তুলনায় অপরিবর্তিত থাকায় বৈশি^ক গড় ৪৩-এর চেয়ে অনেক কম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানে অব্যাহত থাকা সার্বিকভাবে এখনো বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক।
এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধুই প্রতিশ্রুতি আর স্বল্প পরিসরের অভিযানের বাইরে গিয়ে আরো কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। দক্ষিণ এশিয়ায় এ বছরও সর্বনিম্ন ১৬ স্কোর পেয়ে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেনÑ টিআইবির চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, সূচকে বাংলাদেশের স্কোর কমেনি এটুকুই সুখবর, তবে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আমাদের আরো ভালো করার সামর্থ্য ছিল। যদি রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা যেত, অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনের কঠোর প্রয়োগ হতো তাহলে আমাদের স্কোর ও অবস্থানে আরো উন্নতি হতে পারত। প্রধানমন্ত্রীর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’ এবং ‘কাউকে ছাড় না দেয়ার’ ঘোষণার বাস্তবায়নের অন্যতম অন্তরায় এক দিকে বহুমুখী দুর্নীতি সহায়ক যোগসাজশ এবং অন্য দিকে রাজনীতির সাথে অর্থ ও দুর্বৃত্তায়নের নিবিড় সম্পর্ক, যার ফলে রাজনৈতিক ও অন্যভাবে ক্ষমতার অবস্থান ব্যক্তিগত সুবিধা ও সম্পদ বিকাশের জন্য লাইসেন্স হিসেবে বিবেচিত ও ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত মহল ও প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতির যোগসাজশ, সহায়ক ও সুবিধাভোগীদের প্রভাবের কারণে অগ্রগতি অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রকাশিত তথ্যের সাথে দুর্নীতির ধারণাসূচকে ধারাবাহিকভাবে একই স্কোর বজায় থাকা সাংঘর্ষিক কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে এটা যেমন সত্য ও গৌরবের, তেমনি এই অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হতো, আরো সুষম ও টেকসইভাবে হতে পারত যদি আমরা কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম।
সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্কোর আরো ভালো আশা করা স্বাভাবিক ছিল উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রত্যাশা বাড়লেও বাস্তবে কথিত ‘গডফাদার’দের বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে একধরনের শঙ্কা, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের ঘাটতি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের প্রত্যাশা ও চাহিদার প্রতিফলন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শুদ্ধাচারের ঘাটতি বিশেষ করে রাজনৈতিক অর্থায়নে শুদ্ধাচার ও স্বচ্ছতার ঘাটতি, অর্থপাচার ও ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির ক্ষেত্রে আলোচিত মূল হোতাদের বিচারের আওতায় আনতে না পারার মতো বিষয়গুলোর কারণে এই সূচকে আমাদের অবস্থান আরো ভালো হয়নি বলে মনে করছি। বিদ্যমান আইনি কাঠামো সংস্কারের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও যতটুকু আছে সেগুলো যদি কারো প্রতি ভয়-ভীতি বা করুণা প্রদর্শন না করে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হতো, সরকারের ওপর জনগণের আস্থা বাড়ত এবং সূচকে আমাদের অবস্থান আরো উন্নতি হতো।
নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম কর্তৃক দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির অপরিহার্যতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব দেশে বাকস্বাধীনতা, তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিকশিত ও সুরক্ষিত, সেসব দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কার্যকর ও সূচকের অবস্থান উচ্চপর্যায়ে দেখা যায়। অতএব আমাদের সরকারের ওপরও দায়িত্ব এমন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা সংবিধানসম্মতও বটে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মত ও তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি এসব অন্তরায় যত দিন অব্যাহত থাকবে তত দিন দুর্নীতি বিকশিত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ব্যবহার হচ্ছে কোথায়, কার ভোগে যাচ্ছে, সেটি সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। দুর্নীতি না থাকলে আমাদের আরো উন্নতি হতো।
সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১৯ সালের সিপিআই অনুযায়ী বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এবারের বৈশি^ক গড় স্কোর ৪৩ হলেও সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দেশই ৫০-এর কম স্কোর পেয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি দেশের স্কোরের উন্নতি হলেও এবার স্কোর অপরিবর্তিত আছে ৫২টি দেশের এবং উদ্বেগজনকভাবে স্কোর কমেছে ৬৮টি দেশের। এবারের সিপিআই অনুযায়ী ৬৮ স্কোর এবং সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী গতবারের মতোই ২৫তম অবস্থান নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান। এর পরের অবস্থানে ৪১ স্কোর নিয়ে গতবারের তুলনায় দুই ধাপ অবনতি হয়ে ৮০তম স্থানে রয়েছে ভারত। এরপরে শ্রীলঙ্কা ৩৮ স্কোর পেলেও চার ধাপ পিছিয়ে ৯৩তম অবস্থানে রয়েছে। ৩২ স্কোর পেয়ে তিন ধাপ পিছিয়ে ১২০তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। অন্য দিকে, ২০১৮-এর তুলনায় ২ পয়েন্ট কম ২৯ স্কোর পেয়ে ছয় ধাপ পিছিয়ে ১৩০তম অবস্থানে নেমে গিয়েছে মালদ্বীপ। এরপর ২০১৮-এর সমান স্কোর ২৬ পয়েন্ট নিয়ে ১৪৬তম অবস্থানে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের পরে ১৬ স্কোর পেয়ে সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী ১৭৩তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। অর্থাৎ সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ সিপিআই সূচক অনুয়ায়ী ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সপ্তমবারের মতো এবারো দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে।
বিগত দুই বছরব্যাপী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত সর্বনিম্ন তিনটি ও সর্বোচ্চ ১০টি (অঞ্চল ও দেশভেদে জরিপের লভ্যতার ওপর নির্ভর করে) জরিপের সমন্বিত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালের সিপিআই প্রণীত হয়েছে। জরিপগুলোতে মূলত ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশ্লেষকবৃন্দের ধারণার প্রতিফলন ঘটে থাকে।
সিপিআই অনুযায়ী দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার’। আর যেসব জরিপের তথ্যের ওপর নির্ভর করে সূচকটি নিরূপিত হয় তার মাধ্যমে সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের ব্যাপকতার ধারণারই অনুসন্ধান করা হয়। সূচকের তথ্য সংগ্রহে মূলত চারটি ধাপ অনুসৃত হয়। যেমন : উপাত্তের উৎস নির্বাচন, পুনঃপরিমাপ, পুনঃপরিমাপকৃত উপাত্তের সমন্বয় এবং পরিমাপের যথার্থতা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। সিপিআই নির্ণয়কালে জরিপের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সর্বোচ্চ মান এবং বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement