২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পীরগঞ্জে ভুয়া এনআইডি কার্ড দিয়ে ১০ টাকার চাল আত্মসাৎ

সরেজমিন রংপুর
-

রংপুরের পীরগঞ্জের শানেরহাট ইউনিয়নে ১০ টাকার চালে অনিয়মের অন্ত নেই। এখানে চাল আত্মসাৎ করতে চাঞ্চল্যকর সব দুর্নীতি করা হয়েছে। ভুয়া, ডিজিট কম বেশি এনআইডি নম্বর, এক গ্রামের এনআইডিতে অন্য গ্রামের মানুষের নাম ব্যবহার করে চাল উত্তোলন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নয়া দিগন্তের সরেজমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইডি কার্ড ও ব্যক্তি সঠিক থাকলেও তারা চাল পান না। এরা হলেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের দামোদারপুর গ্রামের ওসমানের ছেলে ১০৪ নম্বর কার্ডধারী আতিয়ার রহমান, সাইদুল ইসলামের ছেলে আনারুল ১১৭ নম্বর কার্ডধারী, মোখলেছারের ছেলে এরশাদ (কার্ড নম্বর ১০২) ও খোলাহাটি গ্রামের মৃত ছাত্তারের স্ত্রী বেলি (কার্ড নম্বর ২৩৩), ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেস্টা গ্রামের আবুবক্করের ছেলে সোহেল (কার্ড নম্বর ৪৭৯), ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পালানুসাহাপুর গ্রামের ছাবুর স্ত্রী সাদেকা (৫৬৯) ও রায়তী সাদুল্যাপুর গ্রামের আনারুলের স্ত্রী সুমী এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ধরলাকান্দি গ্রামের সালামের স্ত্রী জোড়বানু (কার্ড নম্বর ৭৭৭)। এদের সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও তাদের চাল দেয়া হয়নি। এভাবে তিন বছর থেকে এই আটজনের নামে উত্তোলনকৃত চালের বর্তমান বাজার দর (১০ টাকা হারে ক্রয়মূল্য বাদে) ৫৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রায়তী সাদুল্যাপুর গ্রামের আনারুলের স্ত্রী সুমী জানান, আমার এনআইডি কার্ড এবং আমাকে ব্যবহার করে চাল তোলা হলেও আমি কখনই চাল পাইনি। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে আমি জানতে পারি আমার নামে চাল উঠেছে তিন বছর ধরে। তা হলে আমার চাল কে বা কারা উঠালো, তা আমি জানতে চাই। আমার নামে উত্তোলন হওয়া চাল আমি চাই। অন্য দিকে ধরলাকান্দি গ্রামের সালামের স্ত্রী জোড়বানু (কার্ড নম্বর ৭৭৭) জানান, আমার নামে তিন বছর ধরে চাল তোলা হয়েছে। আমি জানি না। বিষয়টি জানার পর সাংবাদিক আমার বাড়িতে এলে ইউপি মেম্বার নজরুল ইসলাম আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে নেয়। এ ব্যাপারে জোড়বানুর ছেলে জুয়েল জানান, আপনারা (সাংবাদিক) আসার কথা শুনে আমার মাকে মেম্বার জোর করে তুলে নিয়ে যান। কিন্তু আমার মায়ের নামে তিন বছর চাল উঠেছে। কিন্তু তিনি একটি চালও পাননি।
তালিকায় ভুয়া এনআইডি নম্বর : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তালিকায় ভুয়া এনআইডি কার্ড নম্বর ব্যবহার করে নি¤েœাক্ত কার্ডধারী ব্যক্তি পবন পাড়ার রিপন মণ্ডল (৭২৬), নুরজাহান (৬০৩), ধরলাকান্দির লাবলী (৭২৭), শরিফুল (৭৭৮), দামোদারপুর গ্রামের মাহফুজার (১১৫৩), রাউৎপাড়ার ইমরান (৫৪১) নামে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
তালিকায় এনআইডি নম্বরের ডিজিট বেশি : এ ছাড়াও এনআইডি কার্ডের ডিজিট বেশি দিয়ে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পার্বতীপুর গ্রামের আবু তালেব (কার্ড নম্বর ১৯৩), নুরুল মিয়া (কার্ড নম্বর ৫৫১), ধল্যাকান্দির লাভলী (কার্ড নম্বর ৭৭২), ঘোষপুরের আবদুল হালিমকে (কার্ড নম্বর ২১৩)।
তালিকায় এনআইডি নম্বরের ডিজিট কম : শুধু তা-ই নয়, নামের পাশে কার্ডধারী নম্বরের ব্যক্তিদের এনআইডি কার্ডের ডিজিট কম দেখিয়ে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বড়পাহারপুর গ্রামের সবদেল (১০০৯), রফিক (১০৪০), জেলেখা (১০৪১), শহিদুল (১০৪২), এজাহার (১০৪৩), মোস্তফা (১০৪৪), ওয়েদুল (১০৪৫), রবিউল (১০৪৬), আনারুল (১০৪৭), কোব্বাস (১০৪৮), দবির (১০৪৯), শাহিন মিয়া (১০৩৮), কল্পনা রানি (১০৩৯), রশিদ (১০৫০), মেস্টা গ্রামের আতিয়ার রহমান (১২৫১), হরিরাম সাহাপুর গ্রামের মমিনুল মিয়া (১২৩০), পালানুসাহাপুর নওশাদ (১২৮৯) প্রথমডাঙ্গা গ্রামের শাহ আলী (১৩১৩) কাজিরপাড়ার শামীমা আখতার (১৩২০), পাহারপুর গ্রামের সাউথ (৭৩২), মজনু (৭৩৩) ও সৈয়দকে (৭৩৫)। এভাবে গত তিন বছরের থেকে এই ৩১ জনের নামে উত্তোলনকৃত চালের বর্তমান বাজার দর (১০ টাকা হারে ক্রয়মূল্য বাদে) দুই লাখ ৯ হাজার ২৫০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে শানেরহাট ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো: আবদুল বারী জানান, আমার চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু আমার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভুয়া এনআইডি দিয়ে এবং ১০ টাকার চাল আত্মসাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিকে বিতর্কিত করেছেন। এ ধরনের দুর্নীতিবাজ মানুষ যদি চেয়ারম্যান থাকে, তা হলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ভালো কাজ বিতর্কের মুখে পড়বে। এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
এক গ্রামে বাড়ি, অন্য গ্রামের হয়ে তালিকা নাম : অন্য দিকে এনআইডি কার্ডধারী লোক এক গ্রামের। কিন্তু তাদের এনআইডি ব্যবহার করে চাল তোলে অন্য গ্রামের ব্যক্তি। এ কারণে মূল এনআইডিধারী ব্যক্তিরা বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এরকম কার্ডধারীদের নম্বরগুলো হচ্ছেÑ পার্বতীপুর গ্রামের কার্ড নম্বর ২, ১৯, ২৮, ৩৭, ১৫৬, ১৭০, ১৭২, ১৮১, ২০১, ২০৭, ৭৪০, খোলাহাটি গ্রামের ৫৫৫ থেকে ৫৬২ নম্বর কার্ড, ঘোষপুর গ্রামের ৩১৩, ৩৪৫, ৩৫৮, দিগদাড়ি গ্রামের ৩২২, ৩২৩,৩২৫, মেস্টা গ্রামের ৩৫৮, রাউৎপাড়া গ্রামের ৪৮৬, ৪৮৭, ৪৯০, ১২০৪, হরিরাম সাহাপুর গ্রামের ৪৯৩, ৫১২, ৫১৯, ৫৫৩, ৫৫৫, রাউৎপাড়া গ্রামের ৪৯৪, ৪৯৭, ৪৯৮, ৫০১, ৫০৩, ৫৩০, ৫৪১, ৫৪২, ৫৪৩, ৫৪৪, ৫৬৩ থেকে ৫৬৭, পালানোসাহাপুর গ্রামের ৫৭২ থেকে ৫৭৪, ৫৮২ থেকে ৫৮৫ পর্যন্ত, ৫৯৯, ৬৩৯ থেকে ৬৪১, ৬৮৯, পবনপাড়া গ্রামের ৬০৬, ৬১২, ৬১৮, ৬৪২, ৬৪৫ থেকে ৬৪৭, ৬৮২, ৬৮৩, হরিরাম সাহাপুর গ্রামের ৫৭৬, রায়তি সাদুল্যাপুর গ্রামের ৫২২ থেকে ৫৩৮ পর্যন্ত, ৬৪৮ থেকে ৬৮১, ৬৮৪ থেকে ৬৮৭, ৮৫০, খামার সাদুল্যাপুর গ্রামের ৭০৮ থেকে ৭১৮, ধল্যাকান্দি গ্রামের ৭২৩, ৭৪৬, ৭৫০, ৭৫২, ৭৫৯, ৭৬২,৭৬৩, ৭৬৫, ৭৭০, ৭৯৭, ৮০০, ৮০২, ১২৭৪, ছোট পাহাড়পুর গ্রামের ৮০৫ থেকে ৩১, ৮৫৮, ৮৬২, কাজিরপাড়া গ্রামের ১২৭৪, দামোদারপুর গ্রামের ৪৩, ৪৬, ৫১, ৬০, ৬১, ৬৪, ৭২, ৭৫, ৭৭, ৭৯, ৮১, ৮৫, ৮৭, ৯১, ৯২, ৯৫, ১১৭, ১২২, ১২৩, ১৪৬, ১৪৭, ১৪৯, ৬৯৪, ৬৯৬, ৭০২, ৭০৪, ৭০৫, ৭১৯, প্রথম ডাঙ্গা গ্রামের ৮৬৪, ৮৬৮, ৮৭২, ৮৭৩, ৮৭৬, ৮৭৭, ৮৮৬, ৮৯৭, ৯১৩, ৯১৫, বড় পাহাড়পুর গ্রামের ১০২৮, ১০৩৩, ১০৩৭ এবং মেস্টা গ্রামের ১১৭২ নম্বর কার্ডধারী ব্যক্তিরা। এ ধরনের সর্বমোট ২৩১ জন কার্ডধারীর বিপরীতে চাল তুলে গত তিন বছরে বর্তমান বাজার দরে (১০ টাকা হারে ক্রয়মূল্য বাদে) প্রায় পাঁচ লাখ ১৯ হাজার ৭৫০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ও দামোদারপুর গ্রামের মো: জয়নাল আবেদীন জানান, খাদ্যবান্ধব তালিকায় নাম আছে এক হাজার ৩৫০ জনের। এর মধ্যে যদি ২৩১ ব্যক্তির আইডি কার্ড ব্যবহার করে চাল ওঠানো হয়, কিন্তু ওই আইডিকার্ডধারী ব্যক্তি চাল পান না। বিষয়টি ইউনিয়নে ওপেন সিক্রেট। এটি নজিরবিহীন দুর্নীতি। কিন্তু তার পরও আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে চেয়ারম্যান বহাল তবিয়তে থাকেন কিভাবে। যিনি প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিকে বিতর্কের মুখে ফেলেছেন, তার বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল