২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ধিক্কার

-

বর্বরোচিতভাবে পাঁচ বছরের শিশু তুহিনকে হত্যার ঘটনায় শোকে স্তব্ধ আর ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা। খুনিদের পাশবিকতা হার মানিয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে। খুনিদের ধিক্কার জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করছেন অনেকেই। খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূল শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এলাকাবাসী। সবার একটাই প্রশ্নÑ গ্রামে বিরোধ রয়েছে বড়দের মধ্যে, শিশু বাচ্চার কী অপরাধ? এর সাথে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পেছনে কী রহস্য রয়েছে জানতে চান এলাকাবাসী। গতকাল বুধবার সরজমিনে কাজাউড়া তুহিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সুমসাম নিরবতা বিরাজ করছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়া তুহিনের চাচা নাছিরের ঘরে তালা ঝুলছে। নিহত তুহিনের ঘরের দরজা খোলা থাকলেও সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। পাশের ঘরে চাচা আব্দুল মোছাব্বিরের (ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার) ঘরে রয়েছেন তার সদ্য সন্তান প্রসব করা স্ত্রী জরিনা বেগম ও তার মা। অন্য চাচাদের ঘরেও কেউ নেই। বাড়িতে নেই কোনো পুরুষ সদস্য। জরিনা বেগম বলেন, নবজাতক সন্তানের কারণে রাতের বেশির ভাগ সময় আমাকে নির্ঘুম থাকতে হয়। ওই রাতে তুহিনদের ঘরে শোরগোল শুনে বাচ্চার বাবাকে (স্বামী আব্দুল মোছাব্বির) ঘুম থেকে ডেকে তুলি। পরিবারের সবাই কান্নাকাটি করে তুহিনকে খুঁজতে থাকেন। তুহিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের লোকজন জড়িত তিনি বিশ্বাস করেন না। নিহত তুহিনের মামা নুরুজ্জামানের মোবাইলে ফোন দিয়ে তুহিনের মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, তার মা অসুস্থ কথা বলতে পারছেন না। এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কাজাউড়া গ্রামের বিরোধ দীর্ঘ দিনের। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিয়ে আছেন সাবেক ইউপি সদস্য আনোয়ার মিয়া, অপর পক্ষে নিহত তুহিনের স্বজনরা। গ্রামে আধিপত্য বিস্তার ও সরকারি ডোবা লিজ দেয়াকে কেন্দ্র করে একাধিক হত্যা মামলাসহ ১০-১২টি মামলা রয়েছে। ২০০১ সালের জুন মাসে রাতে খুন হয় পাশের মধুপুর গ্রামের আব্দুর রউফের ছেলে মুজিবুর রহমান। পরদিন সকালে কেজাউড়া গ্রামের পাশে তার লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় মুজিবের পিতা বাদি হয়ে আনোয়ার মিয়া ও নিহত তুহিনের বাবা আব্দুল বাছিরসহ ১৪ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এ মামলা থেকে আনোয়ার মিয়ার ভাতিজা এলাইছ মিয়া, তার ভগ্নিপতি কনরুল ও আব্দুল বাছির ছাড়া সবাইকে পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদনে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২০১০ সালে আনোয়ার মিয়ার পক্ষের জবর আলী নামের এক ব্যক্তি মারা গেলে এলাইছ মিয়াসহ চারজনকে আসামি করে জবর আলীর স্ত্রী বাদি হয়ে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত না পাওয়ায় আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে পুলিশ আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখল করে। ২০১৫ সালে গ্রামের পঞ্চায়েতি ডোবা ইজারা প্রদান নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এসব বিষয়কে সামাজিকভাবে সমাধানের জন্য এলাকার পঞ্চায়েতের লোকজন চেষ্টা চালান। এরই মধ্যে ১৫ সালের ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় স্বামী গিয়াস উদ্দিনের সাথে বাবার বাড়ি আসার পথে পশ্চিম পাড়া মসজিদের পাশে নিলুফা ও তার স্বামীর ওপর হামলা চালায় আনোয়ার মিয়ার পক্ষের লোকজন। এতে নিলুফা ও তার স্বামী গুরুতর আহত হন। এর দুই দিনপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে তারা মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় নিলুফার বাবা জবর আলী বাদি হয়ে আনোয়ার মিয়াসহ ১৬ জনকে আসামি করে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আনোয়ার মিয়াসহ আসামি সবাই জেল খেটে জামিনে রয়েছেন। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সম্প্রতি এ মামলটি আপস-মীমাংসার জন্য চেষ্টা চালান এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। এরই মধ্যে তুহিন হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগে অন্য একটি কোম্পানির চেক ডিজনার মামলায় এক বছর সাজাভোগ করে বাড়ি ফিরেন আনোয়ার মিয়া। এলাকাবাসী মনে করছেন, তুহিন হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গ্রামের দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি ভেস্তে গেল। এলাকাবাসীর প্রশ্নÑ কারা এমনটি করছে, কী তাদের উদ্দেশ্য? তারা মনে করছেন, গ্রামে কোন্দল রাখতেই বারবার এমন ঘটনার জন্ম দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত রোববার রাতে উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কাজাউড়া গ্রামের আব্দুল বাছিরের ছেলে তুহিন মিয়াকে (৫) রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা তার লাশটি রাস্তার পাশের একটি গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে লিঙ্গ কেটে নিয়ে গেছে, দু’টি কান কেটে একটি রাস্তায় ফেলে যায়। এ ঘটনায় ওই দিনই তুহিনের পিতা আব্দুল বাছিরসহ চার চাচা, এক চাচী, এক চাচাতো বোন ও এক চাচাতো ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। রাতে তুহিনের মা বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। পরদিন তুহিনের চাচা নাছির ও চাচাতো ভাই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী প্রদান করার পর বাবা আব্দুল বাছির, চাচা জমশেদ মিয়া ও আব্দুল মোছাব্বির মিয়াকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের প্রেরণ করে। এদের তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবু তাহের মোল্লা। আদালত তিনজনকে তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমানে তারা রিমান্ডে দিরাই থানায় রয়েছেন। নিহত তুহিনের পরিবারের প্রতিপক্ষ আনোয়ার মিয়ার বক্তব্য নেয়ার জন্য তার বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের লোকজন জানান, তিনি অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য দিরাই গেছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement