২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব ঝিলপাড় বস্তির মানুষ ‘উচ্ছেদ করতেই এ আগুন’

মিরপুরে পুড়ে যাওয়া ঝিলপাড় বস্তি হনয়া দিগন্ত -

কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে বের হলেও সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন রূপনগরের চলন্তিকা মোড়ে ঝিলপাড় বস্তির কয়েক হাজার মানুষ। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ছাপ। তবুও ধ্বংসস্তূপে হাতরে বেড়াচ্ছে সব হারানো এই মানুষগুলো। বেশির ভাগ ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি বাসিন্দারা। ওপরে শুধু পোড়া টিন দেখা যাচ্ছে। ঈদের কারণে বেশির ভাগ বাসিন্দা গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। আগুনের খবর পেয়ে অনেকে ফিরে এসেছেন। পোড়া ধ্বংসস্তূপে ঘর খুঁজছেন তারা। তবে বস্তিবাসীদের দাবি, এটা নাশকতা। কোনো চক্রান্তকারীরা এ আগুন লাগিয়েছে। তাদের ধারণা, বস্তি উচ্ছেদ করতে কেউ কেরোসিন দিয়ে এ আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে। এ ঘটনায় গতকাল ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে উপপরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার রাতে ঘটনার কারণ উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অরুণ কান্তি শিকদার জানিয়েছেন।
আগুনের খবর পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্থানীয় এমপি ইলিয়াস মোল্যা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে রূপনগরের চলন্তিকা মোড়ের ঝিলপাড় বস্তিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিট সাড়ে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বিশাল আয়তনের জায়গাজুড়ে ঝিলের ওপর গড়ে ওঠা বস্তিটি চার ভাগে বিভক্ত। এখানে রয়েছে আবাসিক কবিরের বস্তি, চলন্তিকা বস্তি, ৭ নম্বর বস্তি ও হাজী রজ্জবের (স্থানীয় কাউন্সিলর) বস্তি। রজ্জবের বস্তি রক্ষা পেলেও আগুনে পুরোপুরি ছাই হয়ে গেছে বাকিগুলো। রয়েছে শুধু ছাই আর কয়লা। এতে আহত হয়েছেন চারজন।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে এ আগুনের সূত্রপাত। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট কাজ করলেও আগুনের ব্যাপকতা দেখে যোগ দেয় আরো ৯টি ইউনিট। পরে ঘটনাস্থলে যায় আরো আটটি ইউনিট।
বস্তির বাসিন্দা পোশাক শ্রমিক দুলাল সাংবাদিকদের বলেন, আমার ছোট ছোট দুই মেয়ে। স্ত্রী মারা গেছে দেড় বছর আগে। বস্তিতে আমরা ৯টি ঘর ছিল। একটিতে সন্তানদের নিয়ে থাকতাম, বাকিগুলো ভাড়া দেয়া ছিল। সব পুড়ে গেছে। কিছুই বের করতে পারিনি। আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস আসতে দেরি করেছে। আসার পর পানি শেষ হয়ে যায়। এ সময় সব বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
দুলাল আরো বলেন, গত শুক্রবার সকালে একবার বস্তিতে আগুন লেগে ছিল ফরিদের ঘরে। সেই আগুন নেভানোর পর রাতে আবার সেখান থেকেই আগুন লেগেছে।
ডলি বেগম নামে একজন বাসিন্দা বলেন, গোলার মতো আগুন জ্বলেছে। মনে হয়েছে, কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে। ছেলেদের নিয়ে একটি বাসায় থাকতেন ডলি বেগম। তার মোট তিনটি ঘর ছিল, বাকি দু’টি ঘর ভাড়া দিতেন। তাও পুড়ে গেছে।
রাজিয়া বেগম নামে এক নারী বলেন, কেরোসিন দিয়ে আগুন দিয়েছে। গরিবকে এখানে থাকতে দেবে না। তাই সব পুড়িয়ে দিয়েছে। বরিশালের বাকেরগঞ্জের মিতু আক্তার বলেন, এ রকম আগুন জীবনে দেখিনি। সব পুড়ে গেছে। মিতুরও সন্দেহ তাদের বস্তিতে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের ধারণা, বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করেতে কোনো কুচক্রীমহল এ নাশকতা করে থাকতে পারে।
স্থানীয় অনেক লোক বলছেন, এই বস্তিটি অবৈধ। এখানে বেশির ভাগ বাড়ি টিন ও কাঠের। একেকটি বাড়ি টিন দিয়েই তিন-চারতলা করা হয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি করা এসব ঘরের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। বস্তির আশপাশের বাড়িগুলোতেও আগুন নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।
স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল বাশার বলেন, বস্তির পাশেই তাদের বাসা। তারা আগুন ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে ছিলেন। দ্রুত বাড়ি ছেড়ে সবাই বাইরে চলে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আগুন নেভানো সম্ভব হওয়ায় তারা রক্ষা পেয়েছেন।
এ দিকে ফায়ার সার্ভিস বলছে, পানি সঙ্কটের পাশাপাশি সরু গলির কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। অনেক দূর থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি ছিটানো হয়েছে। পুরো এলাকায় প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছিল। আগুন লাগার পর পাইপগুলো গলে আগুনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং মুহূর্তেই পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আগুন ৩০-৪০ ফুট ওপরে পর্যন্ত উঠে যায়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্যাসের সিলিন্ডার ঝিলপাড়ের ওপর গড়ে ওঠা ওই বস্তিতে বিস্ফোরিত হয়।
বস্তির বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম জানান, বস্তিতে তার সাতটি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে দু’টি রান্নাঘর। যেখানে গ্যাসের চুল ছিল। পুরো এলাকাতেই প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বস্তির পুরো এলাকাতেই প্লাস্টিকের গ্যাস লাইন ছিল। যেকোনোভাবে আগুন লাগার পর প্লাস্টিকের গ্যাস লাইনগুলো গলে যায়; যে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
গতকাল সকালে ঘটনাস্থলে সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের সহকারী পরিচালক মো: রেজাউল করিম বলেন, আগুনের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ কিংবা চাপা পড়ে রয়েছে কি না তা তল্লাশি করে দেখা হয়েছে। আমাদের তিনটি ইউনিট সার্চিংয়ে কাজ করেছে। তবে কেউ নিখোঁজ নেই, চাপাও পড়েনি। তিন-চারটি বস্তির ৫৫০ থেকে ৬০০ ঘর পুড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। আগুনে হতাহতের তেমন ঘটনা ঘটেনি। তবে চারজন আহত হয়েছেন।
তবে কিভাবে এই আগুনের সূত্রপাত তা নিশ্চিত করতে পারেনি বস্তিবাসী ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। বস্তিবাসীর অনেকে বলছেন, শর্ট শার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। আবার কেউ বা বলছেন, এই আগুনের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
এ দিকে অগ্নিকাণ্ডের পরপর ও গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বস্তিতে আগুন লাগা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে অস্থায়ীভাবে থাকা-খাওয়াসহ সার্বিক সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের জন্য পার্শ্ববর্তী পাঁচটি স্কুল অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। পুড়ে যাওয়া বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দেন মেয়র। ঢাকা মহানগরে বস্তিবাসীদের বসবাসের জন্য বাউনিয়া বাঁধে স্থায়ীভাবে আবাসন নির্মাণ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ঢাকার সব বস্তি—বাসী স্থানান্তরের কথা জানান তিনি।
ঘটনার কারণ উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে গত শুক্রবার রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অরুণ কান্তি শিকদার জানিয়েছেন। তবে কয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা তিনি নিশ্চিত করেননি।
এ দিকে গতকাল ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে উপপরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেনÑ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (অপারেশনস) আবদুল হালিম ও সহকারী উপপরিচালক নিয়াজ আহমেদ।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করতে হবে : খেলাফত মজলিস
মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের। এক শোকবার্তায় নেতৃদ্বয় বলেন, রাজধানী ঢাকায় বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নগরবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ঘর ভস্মীভূত হয়ে অন্তত তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের সব কিছু ভস্মীভূত হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। এ মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি ত্রাণ সরবরাহ, যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সবাইকে এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement
হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে? গাজায় রিজার্ভ ব্রিগেড মোতায়েন ইসরাইলের উপজেলা নির্বাচন জটিলতা ভোটাধিকারের প্রতি মর্যাদা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাপরাধের ধারাবাহিক ধারা’ অনুসরণের অভিযোগ

সকল