২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অবশেষে রংপুরে এরশাদের দাফন

এরশাদের লাশ রংপুরে নেয়ার সময় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন জি এম কাদের :আইএসপিআর -

প্রেসিডিয়াম সদস্য রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে নজীরবিহীন বিক্ষোভের মুখে অবশেষে অসিয়তকৃত পল্লী নিবাসের লিচুবাগানেই সমাহিত হলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে সামরিক মর্যাদায় লাখো জনতা তাকে দাফন করেন।
মঙ্গলবার ফজরের আজানের পর কিছুটা আবহাওয়া খারাপ হলেও রংপুর মহানগরীতে এরশাদের নামাজে জানাজা ও দাফন কাজে অংশ নিতে উত্তরাঞ্চলের ষোল জেলা থেকে নেতাকর্মী এবং রংপুর অঞ্চল থেকে আসতে শুরু করেন সর্বস্তরের মানুষ। সকাল ৯টায় আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে জনতার ঢল নামে রংপুর কেন্দ্রীয় কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে। যে মাঠে এরশাদ গত কোরবানির ঈদেও নামাজ পরে সবার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। দুপুর ১২টা ১৪ মিনিটে রাজধানীর পশ্চিম পান্থপথের আলিফ মেডিক্যাল সার্ভিসের একটি লাশবাহী ফ্রিজ গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-শ-১১-২৫৯৪) করে রংপুর সেনানিবাস থেকে এরশাদের লাশ আনা হয় কালেক্টরেট মাঠে। এরপর তার লাশকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেয়া হয়, পালন করা হয় নীরবতা। পরে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সিটি মেয়র, ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ছাড়াও জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক, রাজনীতিক, পেশাজীবী, প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ।
অন্য দিকে ইতোমধ্যেই কালেক্টরেট মাঠ ভর্তি হয়ে মানুষের ঢল চলে যায় আশপাশের রাস্তায় ও প্রধান সড়কে। এরই মধ্যে লাশের গাড়ির আশপাশসহ পুরো মাঠ ও নগরীর আনাচে কানাচে চলতে তাকে, এরশাদের কবর রংপুরে দিতে হবে। উপর্যুপরি সেøাগানের মধ্যেই মাইকে বক্তব্য দিতে থাকেন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতারা। বিক্ষোভ আরো বেড়ে গেলে বেলা ২টায় হাতে মাইক নিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য, রংপুর মহানগর সভাপতি ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঘোষণা দেন, স্যারের লাশ আমাদের কাছে আছে। কেউ লাশ নিয়ে যেতে পারবে না। রক্তের বিনিময়ে হলেও পল্লী নিবাসেই স্যারের সমাধি আমরা করব।
এরপর শুরু হয় নামাজে জানাজার প্রস্তুতি। নামাজে জানাজার প্রস্তুতির মধ্যে বক্তব্য রাখেন এরশাদ পুত্র সাদ এরশাদ, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জি এম কাদের বক্তব্য দেয়ার সময় এরশাদকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকায় সমাহিত করার ইঙ্গিত দিলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চলে চরম উত্তেজনা। মঞ্চের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে একপর্যায়ে মেয়র মোস্তফা জি এম কাদেরের হাত থেকে মাইক নিয়ে ঘোষণা দেন, স্যারের দাফন পল্লী নিবাসেই হবে। নামাজে জানাজার প্রস্তুতি নিন। এরপর ২টা ২৭ মিনিটে শুরু হয় নামাজে জানাজা। ইমামতি করেন রংপুর করিমিয়া নুরুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইদ্রিস আলী। নামাজে জানাজা শেষে আবারো লাশের গাড়িকে ঘিরে বিক্ষোভ চলতে থাকে। একপর্যায়ে বেলা ২টা ২৭ মিনিটে লাশের গাড়িতে উঠে পড়েন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও মহানগর সেক্রেটারি এস এম ইয়াসির। এরই মধ্যে রোল পড়ে যায় লাশ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। একপর্যায়ে নিজেই ড্রাইভ করে গাড়ি চালিয়ে মাঠের পূর্ব দিক দিয়ে রওনা দেন মেয়র মোস্তফা। এ সময় গাড়ির সামনে পেছনে হাজার হাজার মানুষের সেøাগান চলতে থাকে। লাশের গাড়ি এগোতে থাকে অতি ধীরে। লাশ ডিসির মোড় হয়ে যাওয়ার কথা থাকায় চেকপোস্ট পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে প্রশাসন। কিন্তু মোস্তফা নিজে গাড়ি চালিয়ে উল্টোপথ সিটি করপোরেশনের দিকে রওনা হন। লাশের গাড়ি যখন সিটি করপোরেশনের সামনে। ঠিক তখনই জি এম কাদের সাংবাদিকদের জানান, আমিও চেয়েছিলাম রংপুরের হোক ভাইয়ের সমাধি। কিন্তু ভাবীসহ অন্যরা ঢাকায় হওয়ার পক্ষে ছিল। রংপুরের মানুষের ভালোবাসার বিষয়টি আমি সাথে সাথে ভাবী রওশন এরশাদকে জানাই। তিনিও রংপুরে দাফনের অনুমতি দেন এবং কবরের পাশে তার জায়গা রাখার কথা বলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটি বিশ্বাস করছিলেন না। সে কারণে ধীরেই এগোতে থাকে লাশ বহনকারী গাড়ি। পরে পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, শাপলা, খামার মোড় লালবাগ কলেজপাড়া দর্শনা হয়ে পল্লী নিবাসে গিয়ে লাশের গাড়ি পৌঁছায় বিকেলে ৪টা ৪৭ মিনিট। পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টারও বেশি। এরই মধ্যে জি এম কাদের, মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ জাতীয় পার্টির ঢাকা থেকে আসা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পল্লী নিবাসে গিয়ে ওঠেন।
অন্য দিকে এরশাদকে সমাহিত করতে খনন করে রাখা পল্লী নিবাসের লিচু বাগানের কবর ও আশপাশের এলাকা সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে সেনাবাহিনী ৫টা ৪০ মিনিটে এরশাদের লাশকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। ৫টা ৪৩ মিনিটে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে নিজের লাগানো লিচুবাগানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এরশাদ। লাখো জনতা দাফন কাফন কাজে অংশ নিয়ে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করেন। গত ৮ জুলাই এরশাদকে রংপুরে দাফন করার দাবি প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement