১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্যাতন বন্ধে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির আলোচনা সভায় বক্তারা
ডিআরইউতে নির্যাতন রোধের দায়দায়িত্ব বিষয়ক আলোচনা সভা : নয়া দিগন্ত -

দেশে একের পর এক হত্যা, গুম ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এসব বন্ধে সরকারের ভূমিকা বরাবরের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ বলে দাবি করেছেন বক্তারা। তারা বলেন, দেশে নির্যাতন বন্ধ করার জন্য শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে, বিচারিক সিদ্ধান্ত আছে এবং বাংলাদেশে ২০১৩ সালে নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ করার জন্য একটি আইন করা হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত এই আইনে কারো শাস্তি হয়নি। এমনকি এই আইনে মামলা করতে গেলেও নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। ওই আইনে ২১০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার বিধান থাকলেও গত পাঁচ বছরেও প্রথম মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। জনগণকে তাদের মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারে না। করলেও সেই উন্নয়ন টেকসই হয় না। নির্যাতিতদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবার মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির উদ্যোগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর রুনি মিলনায়তনে ‘নির্যাতন রোধের দায়-দায়িত্ব’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, নির্যাতন সম্পূর্ণরূপে একটি বেআইনি কাজ এবং কোনো পরিস্থিতিতেই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের সভাপতিত্বে ও নারী অধিকার কর্মী শিরীন হকের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। এ ছাড়াও বক্তব্য দেন, আইনজীবী সারা হোসেন, মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন ও আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম প্রমুখ। আলোচনা সভায় নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন লিমন হোসেন, কোটা আন্দোলনে নির্যাতিত আতাউল্লাহ ও নাইম চৌধুরী।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, দেশে একের পর এক হত্যা, গুম ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে; কিন্তু এসব বন্ধে সরকারের ভূমিকা বরাবরের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনসহ অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তির সদস্য রাষ্ট্র যেখানে নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও এ দেশে নির্যাতন নির্মূলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৩১, ৩২ ও ৩৫)। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। এসবের পরও নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘ ২৬ জুন নির্যাতিতদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে। এর লক্ষ্য হচ্ছে নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা এবং ১৯৮৪ সালের নির্যাতন বিরোধী কনভেনশন যথাযথভাবে কার্যকর করা। ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ‘নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনের’ (নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অমর্যাদাকর আচরণ ও শাস্তির বিরুদ্ধে চুক্তি) সদস্য হয়। কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১৪-এ বলা আছে প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজস্ব আইন ব্যবস্থায় এটি নিশ্চিত করবে যে, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবার উপযুক্ত প্রতিকার এবং পরিপূর্ণ পুনর্বাসনসহ ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ চুক্তিটির পক্ষ হওয়ার সময় ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশ এই অনুচ্ছেদটি নিজস্ব আইন অনুসারে প্রয়োগ করবে। বাংলাদেশের এই ঘোষণা চুক্তিটির দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া হিসেবে তখনি আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়।
তিনি বলেন, নির্যাতনবিরোধী কনভেনশন বা চুক্তিটির প্রতি বাংলাদেশের অনান্তরিক মনোভাব ফুটে উঠে এই চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নজরদারি পদ্ধতিগুলো এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে। বাংলাদেশের দায়িত্ব ছিল চুক্তির পক্ষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে (এবং এরপর প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর) একটি প্রতিবেদন কনভেনশনটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নির্যাতনবিরোধী কমিটির কাছে জমা দেয়া। চুক্তির পক্ষ হওয়ার ২১ বছর অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রথম প্রতিবেদনটিই জমা দেয়নি। নির্যাতনবিরোধী চুক্তিতে কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর নজরদারির জন্য আরো তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্র (অনুচ্ছেদ ২১) এবং বা নিজ রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে (অনুচ্ছেদ ২২) কমিটির কাছে অভিযোগ করার সুযোগ দেয়ার জন্য সদস্য রাষ্ট্রকে আলাদাভাবে সম্মতিমূলক ঘোষণা দিতে হয়। বাংলাদেশ একটি ঘোষণাও দেয়নি। ড. আসিফ নজরুল তার লিখিত বক্তব্যে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশও তুলে ধরেন।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, সিআইডি এবং থানা হেফাজত ছাড়া কোথাও হেফাজতে রাখা নিষিদ্ধ। এমন অনেক রিপোর্ট আছে যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে থানার বাইরে গিয়ে পুলিশের বাড়িতে হেফাজতে রেখে মারধর এবং পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা চাওয়া হয়। এই রিপোর্ট নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে না। দেশের জনগণ এসব বিষয়ে মামলা করতে ভয় পায়। পুলিশ এমন এক বিভীষিকার নাম যার বিরুদ্ধে মামলা করতে সাধারণ মানুষ সাহস পায় না। মাসের পর মাস রিমান্ডের নামে মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সন্দেহের ভিত্তিতে আটককৃত ব্যক্তিদের পরিবারের ওপরে চলতে থাকে অহেতুক নির্যাতন। মানবাধিকার বিষয়টি রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। যেই সময়কালে দেশ দাঁড়িয়ে আছে, নেহাত সুন্দর সুন্দর বইয়ের বক্তব্য দিয়ে জুলম নির্যাতন আর রুখে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। সকলে মিলে একত্র হয়ে একটি আন্দোলনের ডাক দেয়ার মাধ্যমে এই অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, নির্যাতন বন্ধের পাশাপাশি আমাদের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে কথা বলতে হবে। সেই ব্রিটিশ আমলের নিয়মানুসারে এখন কয়েদিদের ডান্ডাবেড়ি পরে থাকতে হয়। ব্রিটিশ আমল পরিবর্তিত হলেও এ ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মধুসূদন চক্রবর্তীর মামলার রেফারেন্স দিয়ে সারা হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধিতার কারণে কাউকে যেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে না হয় এই শুনানির জন্য তিনি আশাবাদী। ইয়াসমিন ধর্ষণ মামলায় পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণের ফলে আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি রুবেল হত্যা মামলার ফলে পরিবর্তিত হওয়া সংশ্লিষ্ট আইনের কথা এ প্রসঙ্গেও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, নিষ্ঠুর, অমানবিক সাজা ও নির্যাতন বন্ধের বিরুদ্ধে সবাই মিলে সোচ্চার হয়ে আওয়াজ তোলার এখনই সময়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ বাস্তবায়নের ব্যাপারে যেখানে অটল সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠন এবং মন্ত্রণালয়ের আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে বলে তিনি মনে করেন। মানবাধিকার কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও আইনজীবীদের ভূমিকা আরো জোরদার কেন হচ্ছে না সেই ব্যাপারে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা একটি নির্যাতনমুক্ত দেশ পাবো বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, কথা বললেই সব কিছু পরিবর্তন হওয়ার আশা ক্ষীণ হলেও আমাদের কথা বলে যেতে হবে। অধিকার না দিয়ে কোনো সমাজ উন্নতি করতে পারে না। আমরা সবাই উন্নতি চাই কিন্তু অধিকার না দিলে ২০৪১ কেন, ২০৬১ সালের মধ্যেও কোনো ধরনের উন্নতি সম্ভব নয়। প্রায় প্রতিদিন রিমান্ড দেয়ার নাম করে ম্যাজিস্ট্রেট সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণœ করার নেপথ্যে কাজ করে চলেছেন। কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য জোর করা যাবে নাÑ যা একটি সাংবিধানিক অধিকার। তবে রিমান্ডের নামে আসামি নির্যাতনের ফলে ব্যাপক হারে লঙ্ঘিত করছে আমাদের সংবিধান। সমাজ নিজ স্বার্থেই নির্যাতন, গুম ইত্যাদির বিচার করবে, কারণ তা ছাড়া সমাজ নিজেই টিকে থাকতে পারবে না। সবাই মিলে অধিকারের জন্য আন্দোলন বজায় রাখার আহ্বান জানান তিনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement