২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পাঠ্যবইয়ে নিপীড়নের সংজ্ঞা অনুসারে পরিবারেই নির্যাতনের শিকার শিশুরা

-

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেত ও লাঠি উঠে গেছে অনেক আগে। কিন্তু তাতে বন্ধ হয়নি লেখাপড়া ঘিরে শিশুনির্যাতন। বর্তমানে পড়ালেখা ঘিরে অনেক পরিবারে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা প্রচণ্ড রকমের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর এ নির্যাতনের শিকার তারা হচ্ছে মূলত মা-বাবার হাতেই।
সপ্তম শ্রেণীর ‘শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য’ বইয়ে একটি অধ্যায়ের নাম বয়ঃসন্ধিকালের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। এ অধ্যায়ে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে যদি কোনো কাজ করতে বাধ্য করা হয় এবং বাধ্যতামূলকভাবে সে কাজ করা যদি তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে তাকে নিপীড়ন বলা হয়। যেকোনো বয়সের ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষকে প্রচণ্ডভাবে বকাবকি করা, উচ্চস্বরে ধমক দেয়া, অপমান করা, শারীরিকভাবে আঘাত করা কিংবা মারধর করাÑ এসব কাজ নিপীড়নের আওতায় পড়ে।’
শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের পড়ালেখা ও পরীক্ষা নিয়ে রাজধানীর অনেক অভিভাবকের সাথে কথা বলার সময় তারা যা জানিয়েছেন তাতে দেখা যায়, মা-বাবার দ্বারাই অনেক শিশু শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেক শিশু স্কুলে ভর্তির পর থেকে প্রতিদিন পড়ার সময় মায়ের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে পড়তে বসা মানেই মারধর। পড়ালেখার বাইরেও বিভিন্ন কারণে তারা অহরহ মারধর ও বকাঝকার শিকার হচ্ছে। বছরের পর বছর এভাবে প্রতিদিন মা-বাবার হাতে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে অগণিত শিশু।
কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে সপ্তম শ্রেণীর শারীরিক শিক্ষাবইয়ে লেখা হয়েছে, কোনো কোনো পরিবারে নিরাপদ পরিবেশ দেখা যায় না। সেখানে শিশুরা খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। বড়দের তিরস্কার, বকুনি ও মারধর খেতে হয়। এরূপ আচরণের শিকার হলে তারা ভয়ে চুপ করে থাকে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
এ বইয়ে আরো লেখা হয়েছে, একটি শিশুর পরিপূর্ণ সুস্থতার সাথে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য বাল্য ও কৈশোর জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তার যেমন পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি দরকার একটি নিরাপদ পরিবেশের। বয়ঃসন্ধিকালে শিশু-কিশোররা শারীরিকভাবে দ্রুত বেড়ে ওঠে। এ সময় তাদের মানসিক বিকাশ ঘটে। ফলে এ সময় তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা খুব প্রয়োজন।
শিশুদের এ নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষার জন্য মা- বাবাকে উদ্দেশ করে বইয়ে লেখা হয়েছে, তারা নিজেরা যেন শিশুদের নির্যাতন না করে এবং অন্যদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার না হয় সে জন্য তাদের সচেতন হতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে শিশু তার আপনজনের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একজন অভিভাবক জানান, তার এক ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। জুনিয়র ওয়ান থেকে তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। স্কুলে ভর্তির পর থেকে যত দিন স্কুল খোলা থাকে আর যত দিন তাকে বাসায় পড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে একদিনও নেই যেদিন তাকে মারতে হয়নি পড়ার জন্য। মারধর আর তীব্র বকাঝকা ছাড়া তাকে পড়ানো সম্ভব হয় না। পড়তে বসাতে হলেও তাকে মারতে হয়। না হলে পড়তে বসানো যায় না। আর পড়তে বসার পর সারাক্ষণ পাশে বসে থেকে পড়তে বলতে হয়। অনেক সময় তাতেও কাজ হয় না। না মারলে সারা দিনেও তার কাছ থেকে পড়া আদায় করা যাবে না। বাধ্য হয়ে মারতে হয়। এ ছাড়া উপায় নেই। মারলেই কেবল মাঝে মধ্যে মনোযোগ দিয়ে সে পড়ে।
রাজধানীর আরেক অভিভাবক জানান, তার এক ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। এখনো তাকে পড়ার জন্য মারধর করতে হয়। না মারলে পড়তে বসে না। বকাঝকার পর পড়তে বসলেও ঠিকমতো পড়ে না। বাধ্য হয়ে মারতে হয়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে কিন্তু এখনো তার নিজের পড়ার বিষয়ে বুঝ তৈরি হয়নি। পরীক্ষার সময়ও পড়ায় কোনো মনোযোগ দেখা যায় না তার মধ্যে। পরীক্ষা নিয়ে তার মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তাও দেখা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের বকাঝকা আর মারধর করতে হয়।
অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা অসহায়। লেখাপড়ার জন্য সন্তানদের মারধর আর বকুনি ছাড়া তাদের করণীয় কিছু নেই। প্রতিদিন স্কুল থেকে অনেক পড়া তৈরির কাজ দেয়া হয়। সাথে থাকে বিপুল হোমওয়ার্ক। লেখাপড়ার বর্তমান পদ্ধতির কারণেই শিশুরা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এত ঘনঘন পরীক্ষা আর পড়ালেখা এত কঠিন না হলে তারা এত নির্যাতনের শিকার হতো না। স্কুলে বছরে কমপক্ষে দু’টি পরীক্ষা ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন ক্লাস টেস্টের ব্যবস্থা থাকে। মোট কথা বর্তমানে পড়ালেখা মানেই সারা বছর শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। পরীক্ষা মানে প্রতিযোগিতা। পরীক্ষার কারণেই শিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
পারিবারিক নানা সমস্যার জেরেও অনেক সময় শিশুরা বড়দের হাতে নির্যাতনের সহজ শিকারে পরিণত হয়। এ ছাড়া পড়ালেখা ঘিরে সন্তানদের এভাবে নির্যাতন করতে বাধ্য হওয়ায় অনেক মায়ের মধ্যেও মানসিক অস্থিরতা আর হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement