২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা

বেড়ে গেছে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা
-

দেশের ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না বলে চলে। এতে কমে গেছে ব্যাংকের নগদ আদায়। এ দিকে আমানত প্রবাহ বাড়ছে না বরং কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার সংস্থান না হওয়ায় সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। এভাবে চলতি অর্থবছরের গত ২১ মে পর্যন্ত ২৫০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। বিপরীতে ব্যাংকিং খাত থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে রেপোর মাধ্যমে নগদ টাকার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২১ ও ২২ মে দুই দিনে ব্যাংকগুলোকে ধার দিয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, চলমান পরিস্থিতিতে কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। একই সাথে কমছে রফতানি আয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে যাচ্ছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে। এতেই বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা বাড়ছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার লেনদেনের সীমা বেঁধে দেয়া হলেও সেটা প্রকৃত অর্থে কার্যকর হচ্ছে না। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নীতিমালার ফাঁকফোকর দিয়ে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দরে ডলার লেনদেন করছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে বছরের শুরুতেই বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। ডলারের সংস্থান না করেই অতিমাত্রায় পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলে কিছু কিছু ব্যাংক। কিন্তু পণ্যের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সময় বাধে বিপত্তি। একসাথে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। বিপরীতে সরবরাহ ওই হারে বাড়েনি। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা বেড়ে যায়। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে থাকে। অপর দিকে ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি কার্যক্রম জোরদার করা হয়। একই সাথে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সীমা বেঁধে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য মূল্য বেঁধে দেয়া হয় ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা।
কিন্তু বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডলারের এ দর কার্যকর হচ্ছে না। দেশের তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, কিছু কিছু ব্যাংকের ডলার সঙ্কট রুটিনে পরিণত হয়েছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে না। কাক্সিক্ষত হারে রেমিট্যান্স সংগ্রহ হচ্ছে না। আবার রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহও কম। এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও আর আগের মতো ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না। ফলে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করতে হয় বাজার থেকে। তাদের ডলার কিনতে হচ্ছে, অথবা একটি নির্ধারিত কমিশনের বিপরীতে ধার নিতে হচ্ছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। তারা ইচ্ছেমাফিক ডলার মূল্য আদায় করছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও তেমন করার কিছু নেই। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া মূল্য ধরেই ফরওয়ার্ড ডিলিং হচ্ছে। ফরওয়ার্ড ডিলিং হলো, যেমন একটি ব্যাংকের পণ্যের আমদানি দায় মেটাতে ১০ কোটি ডলার প্রয়োজন। চাহিদার দিনের ৪ থেকে ৫ দিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেয়া মূল্য ধরে ডলার কেনা হলো। এর সাথে বিনিময় ঝুঁকি বা অতিরিক্ত প্রিমিয়াম যুক্ত হচ্ছে। যেমনÑ চার দিন আগে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১০ কোটি ডলার কেনা হলো। লেনদেনের দিন ২ শতাংশ অতিরিক্ত ধরে অর্থাৎ ৮৬ টাকায় ডলার লেনদেন হলো। এভাবেই বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেয়া দর কার্যকর হচ্ছে না। এ বিষয়ে অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তাদের করার কিছুই নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে আটকাতে না পারলেও তাদের ডেকে এনে সতর্ক করতে পারে। কিন্তু তাও করা হচ্ছে না। ফলে এক শ্রেণীর ব্যাংক চুটিয়ে ব্যবসা করছে। তারা জিম্মি হয়ে পড়ছে ওই ব্যাংকগুলোর কাছে।
অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার সরবরাহ করলে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু তা করা হচ্ছে না।
এ দিকে ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবাহ কমে গেছে। কমে গেছে নগদ আদায়। একই সাথে বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নগদ টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে বাজারে টাকার সঙ্কট আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকগুলো নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আমানতের সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত বেশি সুদ দিয়ে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের আমানতকারীদের টানছে। অপর দিকে কিছু কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিচ্ছে। যেমনÑ গত ২১ মে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা রেপোর মাধ্যমে ধার করা হয়েছে। এক দিনের জন্য ধার নিতে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ব্যাংকগুলোকে গুনতে হয়েছে ৬ টাকা সুদ। অনুরূপভাবে ২২ মে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা ধার করেছে ৮টি ব্যাংক।
দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, বাস্তবতা হলো- অনেক ব্যাংকেই তীব্র তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেকেই আমানতকারীদের অর্থ ফেরত না দিয়ে সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেক ব্যাংক ঋণ সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করছে। ঋণ মঞ্জুর করেও তা বিনিয়োগ করতে পারছে না। এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ আমানতের অনুপাত কমিয়ে আনার খড়গ ঝুলছে। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ৮৩ শতাংশে এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোকে ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। রাতারাতি ঋণ আদায় করা যাবে না, ফলে আমানত সংগ্রহ করেই এ অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু আমানত সরবরাহ না বাড়ার আশঙ্কাই রয়েছে। ফলে বছরের শেষ সময়ে এসে আমানত সংগ্রহ নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যাবে। সবমিলে সামনে ব্যাংকিং খাতের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি না থাকলে এ খাতে অস্থিরতা আরো বেড়ে যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement