১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোটি টাকা ঋণখেলাপির সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি

-

উনারা ভিআইপি ঋণখেলাপি। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের খাতায় উনারা এখন কোটিপতি ঋণখেলাপি। অবাক হলেও সত্য যে, কোটিপতি ঋণখেলাপির সুনাম অর্জন করেছেন এমন ব্যক্তি ও কোম্পানির সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে চলে গেছে। সম্প্রতি হালনাগাদ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এর বাইরে আরো ছয় শতাধিক ঋণখেলাপি আছেন যাদের প্রত্যেকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কোটি টাকার ওপরে কিন্তু তারা উচ্চ আদালত থেকে খেলাপিঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। এ কারণে তাদের নাম ১০ হাজার কোটিপতি ঋণখেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। তবে তাদের অ্যাকাউন্টে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এক কোটি টাকা থেকে হাজার কোটি টাকারও ঋণখেলাপি রয়েছে এ তালিকায়।
দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ঋণখেলাপির সংখ্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, ছোট-বড় মিলে ঋণখেলাপির সংখ্যা রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ। তাদের কাছে পাওনা রয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। তবে অতীতে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় ছিল এমন বড় বড় শিল্প গ্রুপের নাম নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এ তালিকায়। বিশেষ বিবেচনায় এসব শিল্পগ্রুপের অনিয়মিত ঋণকে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এ জন্য খেলাপিঋণের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
যেমন বছর দুয়েক আগে, মাত্র এক ও দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১১টি শিল্পগ্রুপ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপিঋণ নবায়ন করেছিল। ওই সব ঋণের বেশির ভাগই আদায় হচ্ছে না। দু’টি গ্রুপ সামান্য ঋণ পরিশোধ করেছিল; কিন্তু বাকি ৯টি কোনো ঋণই পরিশোধ করেনি। তারা উচ্চ আদালতে রিট করেছে ঋণখেলাপির ওপর। অর্থাৎ সাময়িকভাবে তাদেরকে ঋণখেলাপি বলা যাবে না মর্মে তারা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন।
আবার অতীতে শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকায় ছিল এমন বড় বড় শিল্প গ্রুপের ঋণ এখন আর খেলাপি হিসেবে নেই। বিশেষ সুবিধা নিয়ে ওই সব ঋণ এখন নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। যেমন, চট্টগ্রামভিত্তিক একটি বড় শিল্পগ্রুপের কোনো ঋণই এখন খেলাপি নেই। সবঋণই নিয়মিত দেখানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষ খেয়ে এখন বিষ হজম করার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই নীতিমালা অনুযায়ী ফাইলে মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। উপর থেকে যেভাবে চাওয়া হচ্ছে সেই ভাবেই ফাইল অনুমোদন করতে হচ্ছে।
অগ্রণী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সবগুলো ব্যাংক থেকেই ঋণ নিয়ে ফ্লাইওভার করেছিল; কিন্তু আইনগত ফাঁকফোকর দেখিয়ে এখন অর্থ পরিশোধ করছেন না। তাই ওই গ্রুপের কোনো ঋণই এখন আর খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, বেশির ভাগ ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়মিতভাবে পরিশোধ করছে। অথচ বেশির ভাগ বড় বড় শিল্পগ্রুপ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছে না। তারা উচ্চ আদালতে রিট করছেন। ফলে ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে ঋণখেলাপি বলা যাচ্ছে না। ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তি কোনো জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না এবং নতুন করে ঋণ নিতে পারেন না। কিন্তু বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলো উচ্চ আদালত থেকে খেলাপিঋণের ওপর স্থাগিতাদেশ নিয়ে আবার অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। পরিশোধ না করায় আবার তা খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে এক একটি শিল্পগ্রুপের বিপরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোটি টাকার ওপরে ঋণখেলাপি রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন ব্যক্তিদের একটি তালিকা সম্প্রতি করা হয়েছে। ওই তালিকায় এক কোটি টাকা থেকে হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি রয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এ তালিকায় ১০ হাজারের ওপরে কোটিপতি ঋণখেলাপি রয়েছেন। কিন্তু এর বাইরেও প্রায় ৬০০ কোটিপতি ঋণখেলাপি রয়েছেন যাদেরকে আইনের বাধ্যবাধকতায় ঋণখেলাপি বলা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী নতুন ঋণ পাওয়ার জন্য খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করে উচ্চ আদালতে যান। তারা উচ্চ আদালত থেকে কয়েক মাসের জন্য খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নেন। অর্থাৎ ওইসময়ে তাকে ঋণখেলাপি বলা যাবে না। আদালত ওই ঋণ নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে না মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে ওইসব ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবিতে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও পরে তা নিয়মিত হিসাবে রাখতে বাধ্য হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ঋণখেলাপিরাই এই সুযোগটি বেশি নিচ্ছেন। এর সাথে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো গ্রাহকের ঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করলে, তিনি আদালতে যেতে পারেন। আদালতে রিট করে তাকে ঋণখেলাপি বলা যাবে না এই মর্মে নির্দেশনা পেতে পারেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আদালতের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে যথাযথ যুক্তি উপস্থাপন করে রিট খারিজ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। একই সাথে ওই ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিজস্ব সিআইবিতে আবার খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করার সময় এ বিষয়ে নানা অনিয়ম উঠে আসে। যেমনÑ গ্রাহক উচ্চ আদালতে রিট করে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিচ্ছেন; এর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে যথাযথ যুক্তি উপস্থাপন করে রিট খারিজ করে না। নেয়া হয় না যথাযথ আইনি পদক্ষেপ। এভাবে গ্রাহকের সাথে যোগসাজশ করে একশ্রেণীর অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা নতুন করে ও ওই গ্রাহককে ঋণ দিতে সহযোগিতা করে থাকেন। তিনি বলেন, প্রভাবশালী ঋণখেলাপি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না।


আরো সংবাদ



premium cement