২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
মানবপাচার : যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন নিয়ে সভায় উদ্বেগ

ডিসিদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে না টাস্কফোর্স

-

দীর্ঘ দিন ধরে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আকাশপথে অভিনব কৌশলে মানবপাচারের ঘটনা ঘটলেও এই চক্রের মূল হোতারা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইতোমধ্যে পাচারকারী দলের খপ্পরে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া, ইরাক, মিশর ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীরা জিম্মি অবস্থায় মানববেতর জীবন কাটাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, চক্রের সদস্যরা দেশে থাকা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে আটকদের নির্যাতনের ভয়ভীতি দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নেপথ্যে থেকে কারা এসব অসহায় মানুষকে আসিয়ানভুক্ত, মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলছে, তাদের অদ্যাবধি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গঠিত ভিজিলেন্স টাস্কফোর্স সদস্যরাও চিহ্নিত করতে পারছেন না। তবে ভিজিলেন্স টাস্কফোর্সের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনায় বিদেশগামীদের সাথে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণা ঠেকাতে করণীয়র পাশাপাশি বাংলাদেশ যাতে কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের ভিত্তিতে মানবপাচার সূচক ৩-এ নেমে না যায়, সে জন্য সব জেলা প্রশাসককে অনিরাপদ অভিবাসনের সাথে জড়িত ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৩ মাস আগে। কিন্তু জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে এ নিয়ে টাস্কফোর্স সদস্যরা কাক্সিক্ষত সহায়তা পাননি। এ সুযোগে সারা দেশে মানবপাচার চক্রের সদস্যরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী একটি নৌকাডুবে অন্তত ৩৯ জন বাংলাদেশী নিখোঁজ হন। উদ্ধারকারীদের তৎপরতায় জীবিত উদ্ধার হন ১৪ জন। এ ঘটনার পর বিশ্বে নতুন করে সমালোচনায় আসে বাংলাদেশ থেকে নৌপথে মানবপাচারের ইস্যুটি। এর পরই ঘটনার তদন্ত শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তদন্তে তারা জানতে পারেন, ইউরোপে মানবপাচারের সাথে দেশজুড়ে অন্তত ১০-১৫টি চক্র জড়িত। এর মধ্যে ৫-৬টি চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া বাংলাদেশীরা সে দিনের নৌ দুর্ঘটনার শিকার হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: নাজীবুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত ৩০ জানুয়ারি ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভিজিলেন্স টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আলোচ্যসূচি থেকে জানা গেছে, বছরে কমপক্ষে ১৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ভিজিলেন্স টাস্কফোর্স কর্তৃক পরিচালনা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে ১৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে বর্তমান অর্থবছরে আরো বেশি পরিমাণ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা প্রয়োজন। আবার এ মন্ত্রণালয়ের ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে ভিজিলেন্স টাস্কফোর্সের সদস্যভুক্ত বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি প্রয়োজন। আগে এ মন্ত্রণালয়ের ম্যাজিস্ট্রেটরা কেবল বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করলেও অনিরাপদ অভিবাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকসংখ্যক অপরাধকে বিচারের আওতায় আনার জন্য মোট ১১টি আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। টাস্কফোর্সের বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কুষ্টিয়া জেলায় ১৩৬৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৯ কোটি ৯৬ লাখ ৭ হাজার ১২৫ টাকা আদায় এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ৫৭০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৬ হাজার ৪০০ টাকা আদায় করা হলেও সাতক্ষীরা জেলায় মাত্র একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু কোনো টাকা জরিমানা করা হয়নি।
টাস্কফোর্সের আলোচনায় একটি বিষয় উঠে আসে। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ যাতে কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের ভিত্তিতে মানবপাচারের সূচক ৩-এ না নেমে যায়, সে জন্য টাস্কফোর্স সভাপতি নাজীবুল ইসলাম দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসককে অনিরাপদ অভিবাসের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে টাস্কফোর্স সদস্যদের অনুরোধ জানানো হয়। টাস্কফোর্সের অনুষ্ঠিত বৈঠকে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা ইয়াকুব শরাফতী, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইএর প্রতিনিধি, বিজিবি প্রতিনিধি, বাংলাদেশ পুলিশ, হাব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে হাবের সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা ইয়াকুব শরাফতী বলেছেন, দেশে অনেক এজেন্সি আছে যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। অথচ তারা নিরীহ লোকদের সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এসব ব্যক্তি বা এজেন্সির তথ্যাদি জানা দরকার।
এনএসআইএর প্রতিনিধি জানান, এমনভাবে অভিযান করতে হবে, যেন মূল সমস্যা সমাধান হয় এবং কোনো গ্যাপ না থাকে। তার জন্য দালালদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এ মন্ত্রণালয় থেকে এনএসআইএর ডিজি বরাবর পত্র প্রেরণ করা হলে সেই অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় অভিযান চালানো যাবে।
গতকাল শনিবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: নাজীবুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, গত ৩০ জানুয়ারির পর ২৯ এপ্রিলও টাস্কফোর্সের নিয়মিত বৈঠক হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার জন্য সারা দেশে জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ জানানোর ফলোআপ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেগুলার তারা রিপোর্ট পাঠায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যাটা হলো, উনারা ঠিক আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চান। এটিই একটা সমস্যা। এরপর তিনি বলেন, আসলে ডিসি অফিসের নিজস্ব কোনো সোর্স নেই। এর জন্য তাদের পক্ষ থেকে আসল তথ্য পাওয়াটাও মুশকিল। আমরা যতটা প্রত্যাশা করছিলাম ডিসি সাহেবদের কাছ থেকে আসলে অতটা ফলাফল পায়নি। এখন আমরা এনফোর্সমেন্ট উইং ডিফারেন্টভাবে এগোতে চিন্তা করছি। তবে ডিসিদের কার্যক্রমে হতাশ, এ কথা আমি বলব না। মানবপাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানবপাচার তো আর এক দিনে বা এক মাসে হয়নি। আসলে প্রতারক চক্রগুলো ঢাকা শহরে ও ঢাকার বাইরে এমনভাবে নিরীহ লোকগুলোকে প্রলুব্ধ করেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য হয়তো বা মিডলিস্ট হয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ কাজটি করতে গিয়ে তারা নিজেরাই ফাঁদে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের ভিত্তিতে মানবপাচার সূচক নিয়ে টাস্কফোর্স উদ্বিগ্ন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই আমরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরাও বসে নেই। প্রতিনিয়ত এই চক্রগুলোকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু আমাদের তো সোর্স নেই। সোর্স মানিও নেই। এর মধ্যে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement