১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোজা ভেঙে হিন্দু রোগীদের রক্ত দিলেন আসামের যে মুসলমানেরা

-

ভারতে আসামের হাইলাকান্দি জেলায় ক’দিন আগেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে এবং যার জেরে এখনো সেখানে দিনের কিছুটা সময় কারফিউ চলছে। কিন্তু ওই রাজ্যেরই অন্য কয়েকটি জায়গায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির এক অন্য ছবি উঠে এসেছে। অন্তত দু’জন ইসলাম ধর্মাবলম্বী স্বেচ্ছায় রোজা ভেঙে রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন দুই হিন্দু ধর্মাবলম্বী রোগীর।
আসামের বিশ্বনাথ চরিয়ালির বাসিন্দা অনিল বোরা তার ৮২ বছর বয়সী মা, রেবতী বোরাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন গত সপ্তাহে। কিছু পরীক্ষার পরে জানা যায় তাকে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দিতে হবে। মিসেস বোরার রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ। সেই রক্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
ফেসবুকের মাধ্যমে একটি স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠনের সাথে অনিল বোরার যোগাযোগ হয় শোনিতপুরের বাসিন্দা মুন্না আনসারির সাথে। গত রোববার আনসারি রোজা ভেঙে রক্ত দিয়েছেন রেবতী বোরাকে।
‘আমাকে যখন প্রথম রক্ত দিতে হবে বলা হলো, আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি আমাকে ফোন করেছিল, আমি নিজেও তার সদস্য।’
‘ওরা আমাকে বলে ভেবে দেখ, রোজা ভাঙতে হবে কিন্তু। আমি বলেছিলাম রোজা ভাঙতে হলে হবে। তবে যদি রাতে রক্ত দিলে কাজ হয়, তাহলে রোজার শেষেই হাসপাতালে যাবো, আর না হলে রোজা ভেঙে দেবো!’ বলছিলেন শোনিতপুরের বাসিন্দা, ছোট এক দোকানদার আনসারি।
প্রথমে মুন্না আনসারিকে জানানো হয় যে রাতে রক্ত দিলেও চলবে। কিন্তু পরে জানানো হয় যে তক্ষুণি রক্ত দিতে হবে। তখন রোজা ভেঙেই হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসেন মুন্না আনসারি।
অনিল বোরা বলছেন, ‘রোজা ভেঙে তিনি যেভাবে আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়েছেন, তার জন্য ওর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’
গোলাঘাট জেলার বাসিন্দা ইয়াসিন আলী রোজার শেষে বাবার সাথে হাসপাতালে গিয়েছিলেন ওজন মাপতে। সেখানে গিয়ে হঠাৎই এক ব্যক্তির সাথে দেখা হয়, যিনি আড়াই বছরের মেয়ের জন্য রক্ত খুঁজছিলেন। সাথে সাথেই রক্ত দিতে রাজি হয়ে যান ইয়াসিন আলী।
বিবিসি বাংলাকে টেলিফোনে তিনি বলছিলেন, ‘যদিও আমাকে রোজা ভাঙতে হয়নি সে দিন রক্ত দেয়ার জন্য। তবে প্রয়োজন হলে ভাঙতেও দ্বিধা করতাম না।’
‘কুরআনেই তো আছে একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সব থেকে বড় কাজ। তার জন্য রোজা যদি ভাঙতে হয়, তাতেই বা কী যায় আসে?’
ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ‘টিম হিউম্যানিটি’ অনেক বছর ধরেই রোগীদের জন্য রক্তদাতাদের ব্যবস্থা করে। সংগঠনটির প্রধান দিব্যজ্যোতি কলিতার বাবার জন্য রক্ত জোগাড় করতে পারা যায়নি। তার মৃত্যু হয়েছিল। তখন থেকেই রক্তদাতা জোগাড় করেন তিনি। কয়েক বছর হলো এর জন্য ফেসবুক ব্যবহার করছেন তারা। রোজা রেখে রক্ত দেয়া প্রসঙ্গে কলিতা বলেন, ‘রোজা বা উপোস করলে শরীর এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তার পর যদি রক্ত নেয়া হয়, শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।’
‘সে জন্যই রক্ত নেয়ার আগে ব্লাড ব্যাংকে বিশেষভাবে জেনে নেয়া হয় যে রক্তদাতা কতক্ষণ আগে খাবার খেয়েছেন। আবার রক্ত দেয়ার পরেও ফলের রস, ফল এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার দেয়া হয়।’
কলিতা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এমনিতেই রক্ত দেয়ার পরে অনেকের মাথা ঘুরতে পারে, তার জন্য সাবধান থাকতে বলা হয়। আর যদি কোনো খাবার না খেয়ে রক্ত দেন কেউ, তাহলে অসুস্থ হয়ে পড়া অনিবার্য।’
গোয়াহাটির একটি হাসপাতালের কর্মী পান্নাউল্লা আহমেদকেও ব্লাড ব্যাংকের ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে খাবার খেয়েছেন কি না তিনি।
‘আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম, যে আমার পেট ভরা আছে। কিন্তু আমার তো রোজা চলছে, কী করে খাবো! তাই খালি পেটেই ছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে মিথ্যে বলাটা ঠিক হয়নি।’
পান্নাউল্লা আহমেদ বলেন, ‘তাই রক্ত দেয়ার পরে একটা হোটেলে ঢুকে ভালোমতো খাওয়া-দাওয়া করে। এভাবেই সে দিন আমি রোজা ভেঙে ফেলি। পরের দিন থেকে আবারো রোজা রাখছি।’ গোয়াহাটির একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী তিনি।
তার এক বন্ধু জানতে পারেন যে এক রোগীর রক্ত লাগবে। পান্নাউল্লা আহমেদের রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ। আর রোগীরও পজিটিভ। অনেক খুঁজেও রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতাল থেকেই বলা হয় যে ‘বি’ পজিটিভ রক্ত দিয়ে তার বদলে রোগীকে তারা সঠিক গ্রুপের রক্ত দিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু আনসারির সেই বন্ধু তাপস ভগবতী বলেছিলেন, ‘তুমি কী করে রক্ত দেবে! রোজা ভাঙতে হবে তো তাহলে!’
‘আমি চাইছিলাম রক্ত দিতে, তার জন্য যদি রোজা ভাঙতে হয় তো হবে! একজন মানুষের প্রাণ তো বাঁচাতে পারব! তবুও আমি বাড়ির অনুমতি নিয়ে নিই। তারা মতো দেয়।’ ‘কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ডাক্তারকে মিথ্যে কথাই বলে দেবো যে পেটভর্তি আছে। যদি মাথা না ঘোরায়, তাহলে আর রোজা ভাঙব না। তাতে রক্ত দেয়াও হবে, আবার রোজাটাও ভাঙতে হবে না।’
আনসারি জানান, ‘কিন্তু ভেবে দেখলাম যে মিথ্যে বলা উচিত নয়, তাই রক্ত দেয়ার পরে খেয়ে নিয়েছিলাম।’
এদের ঘটনা এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এই তিনজনই বলছেন যে তারা একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে যা করা উচিত বলে মনে হয়েছে, সেটিই করেছেন। এত প্রচার করার কিছু হয়নি এ নিয়ে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement