২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
প্রাক-বাজেট আলোচনায় সম্পাদক ও সুশীলসমাজ

প্রয়োজন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও পুঁজিবাজারকে ঢেলে সাজানো

এত সুদে ব্যবসা করা সম্ভব নয় : অর্থমন্ত্রী
-

দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পত্রিকার সম্পাদকগণ ও সুশীল সমাজ আগামী বাজেটে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পুঁজিবাজারকে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ফিরিয়ে আনতে ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বাংলাদেশের মতো এত বেশি ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ সুদ হার পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। এত সুদে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। আমরা সুদ হার কমিয়ে আনার চিন্তা করছি। পুঁজিবাজার নিয়ে মানুষের গালাগালি আর শুনতে চাই না।
শেরেবাংলা নগরস্থ এনইসি সম্মেলন কক্ষে গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গণমাধমের সম্পাদক, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম ও এনজিও নেতাদের সাথে প্রাক-বাজেট ২০১৯-২০ আলোচনায় সম্পাদকরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, পরিবেশ আন্দোলনের আবু নাসের খান ও ফারাহ কবীর।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা খুব ভালো আছে এটা বলব না। তবে খুব খারাপও নেই। এ খাতের উন্নয়নে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি হচ্ছে। অনেকেই খেলাপি ঋণের বিপরীতে কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না। মামলা করতে পারছে না। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের ওপর নতুন করে সুদ আরোপ করা হচ্ছে। আগামীতে সুদের হার অনেক কমিয়ে নিয়ে আসা হবে। যাতে ঋণ খেলাপি না হয়। মন্ত্রী বলেন, আমার ওপর বিশ^াস রাখুন। অসততা আমাকে স্পর্শ করেনি, করবেও না। আমি অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। সাধারণ মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমি অনুরোধ করব দেশের মানুষের চলার পথে যাতে প্রতিবন্ধকতা না হয় সে জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। সবাইকে সবার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কেউ ঋণ গ্রহণ করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবসা করলে লাভ বা লোকসান হতে পারে। যারা লোকসান দেয় তাদের জন্য কিছু করার ব্যবস্থা থাকে না। ঋণ খেলাপি হওয়ার পরও সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠালে তো হবে না। সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আসবে সেগুলো শতভাগ স্ক্যানিং হয়ে আসবে। আবার যেসব পণ্য রফতানি হবে সেগুলোও শতভাগ স্ক্যানিং করা হবে। তাছাড়া র্যান্ডম শ্যাম্পলিং-এর মাধ্যমে পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করা হবে। আমদানির ক্ষেত্রে অতিমূল্য ও কম মূল্য দেখিয়ে মানিলন্ডারিং হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, যারা আয়কর দেয় তারাই শুধু কর দিয়ে যাচ্ছে। আর যারা কর দেয় না তারা দেয়ই না। দেশের ৪ কোটি মানুষ কর দেয়ার যোগ্য হলেও কর দেয় মাত্র ১৮ থেকে ২০ লাখ। এ জন্য ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স নির্ধারণ করা হবে। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, করের আকার বাড়ানো হবে না। তবে বাড়বে কর নেটের আকার। আরকর ও ভ্যাট দিতে যারা সক্ষম তাদেকে নেটের আওতায় আনা হবে।
আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি কি করে কমানো যায় আগামী বাজেটে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কারণ আর তো পারা যাচ্ছে না। হাঁটার কোনো পরিবেশ নেই। ফুটপাথ ব্যবসায়ী ও হকারদের দখলে। হাঁটার পথ তো দেখছি না। বাংলাদেশের মানুষকে হাঁটতে হলে ইংল্যান্ডে যেতে হবে। গাড়ির ওপর আরো বেশি হারে ট্যাক্স আরোপ করা উচিত। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারগুলো ক্ষতি করছে। একটা ফ্লাইওভার মানে সড়কের বিপর্যয়। ফ্লাইওভার না করে যদি ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টকে কার্যকর করা হতো তাহলে যানজট অনেক কমে যেত। ফ্লাইওভারের দৌরাত্ম্য চলছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আর্থিকভাবে খারাপ সময় পার করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ইলেক্ট্রনিক টেন্ডারের কারণে সরকারের বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমে এসেছে। বিজ্ঞাপন দেয়া হলেও এর পরিধি থাকে তুলনামূলক কম। এ অবস্থায় সরকারি বিজ্ঞাপনের দর বাড়ানো ও বিজ্ঞাপনের ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব দেন তিনি। তিনি বলেন, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমকে শিল্প ঘোষণা করে এ খাতে ব্যাংক ঋণ বাড়ানোর প্রস্তাবও দেন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে আপনার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। ফলে আয়ও কমে যাচ্ছে। অনলাইনেও আয় তেমন নেই। সংবাদপত্র প্রকাশে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বাড়ছে। ভ্যাট আইনে সংবাদপত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া আছে। এরপরেও এই খাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই কর প্রত্যাহার করতে হবে। করপোরেট ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব করেন তিনি।
সাংবাদিকদের বাড়িভাড়া হিসেবে পরিশোধিত অর্থের শতভাগ করমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে মতিউর রহমান বলেন, মূল বেতনের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িভাড়ায় বর্তমানে করমুক্ত রয়েছে। বর্তমান বেতন কাঠামোতে সাংবাদিকদের বাড়িভাড়া দেয়া হয় ৭০ শতাংশ। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ বাড়িভাড়ার ওপর কর প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার করে কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বাড়ি কেনা হচ্ছে। এসব দেখা দরকার।
নঈম নিজাম বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে আজ নানা প্রশ্ন। ব্যাংকগুলোর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর তাদেরকে আর পাওয়া যায় না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাদেরকে মাফ করে দেয়া হয়। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এটাই হলো আপনার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শেয়ারবাজারকে কিভাবে ইউটার্ন করানো যায় আগামী বাজেটে সেটির ব্যাপারেও কোনো নির্দেশনা আসা উচিত। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি করছে কাস্টমস। যারা চোরাচালানের সাথে জড়িত তাদের তালিকা কাস্টমস ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে। তাহলে কেন সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হবে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্রের নজরদারি কাঠামোটাই আজ ভেঙে গেছে। সমালোচনাটাও গণতন্ত্রের একটা নজরদারি। আমাদের বাজেটের অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরিবর্তন আনা দরকার। বাজেটকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। শিক্ষার মান আমাদের এখনো বাড়েনি। এটার প্রতি নজর দেয়া দরকার। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসন আজ খুবই প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থায় দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন জড়িত।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, মানবসম্পদকে দক্ষ জনবল না বানিয়ে, দক্ষ সন্ত্রাসী বানানো যেন না হয়। সে দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। প্রতিবন্ধীদের উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের সুবিদা বাড়াতে হবে। শিক্ষা গবেষণায় তেমন কোনো বরাদ্দ দেয়া হয় না।

 


আরো সংবাদ



premium cement