২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলার বার ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে পানাম নগর

অনন্য স্থাপত্য
-

বাংলার বার ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে পানাম নগর। নারায়ণগঞ্জ জেলার, সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর পানাম নগর। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগরÑ প্রাচীন সোনারগাঁওয়ের এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বার ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। সোনারগাঁওয়ের ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে।
সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর থেকে উত্তর দিকে হাঁটাপথেই পৌঁছা যায় অর্ধচন্দ্রাকৃতি পানাম পুলে। পুলটির দৈর্ঘ্য ছিল ৭২ ফুট আর প্রস্থ ছিল ১৫.৫ ফুট, মধ্যখানটা ছিল উঁচু। এই পুল পেরিয়েই পানাম নগর এবং নগরী চিরে চলে যাওয়া পানাম সড়ক। আর সড়কের দুই পাশে সারি সারি আবাসিক একতলা ও দ্বিতল বাড়িতে ভরপুর পানাম নগর।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসত বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেত মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়ত পালতোলা নৌকা। প্রায় ওই সময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে পানাম নগরী। পরে এই পোশাক বাণিজ্যের স্থান দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। ইংরেজরা এখানে বসিয়েছিলেন নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র।
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের অভিমত হলো, সুলতানি আমলে পানাম ছিল সোনারগাঁওয়ের রাজধানী; কিন্তু পানামে, সুলতানি আমলের তেমন কোনো স্থাপত্য নজরে পড়ে না, তাই এই দাবিটির সত্যতা ঠিক প্রমাণিত নয়। এ ক্ষেত্রে জেম টেলর বলেছেন, সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন শহর ছিল পানাম। এই তত্ত্বটির সাথে বাস্তবের কোনো বিরোধ নেই। শহরটিতে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা বাড়ি রয়েছে প্রচুর, যার বেশির ভাগ বাড়িই ঊনবিংশ শতাব্দীর (১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের নামফলক রয়েছে)। মূলত পানাম ছিল হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিল ঢাকা-কলকাতাজুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর।
১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মুঘলদের সোনারগাঁও অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পানাম পুল (বিলুপ্ত), দুলালপুর পুল ও পানাম নগর সেতুর অবস্থান ও তিন দিকের খালবেষ্টনী থেকে বোঝা যায় পানাম সোনারগাঁওয়ের একটা উপশহর ছিল।
বাংলার স্বাধীন রাজা ঈসা খাঁর পদচারণা ছিল এই নগরীতে। সুলতানি আমল থেকে এখানে বিকশিত ছিল বাংলার সংস্কৃতি।
পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলোর বেশির ভাগই আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মুঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহারোপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণকৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী কুশলতায় ভরপুর। ইটের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী স্থানে নীল ও সাদা ছাপ দেখা যায়। এ ছাড়া বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ নিখুঁত। কাস্ট আয়রনের এই কাজগুলো ইউরোপের কাজের সমতুল্য বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এর সাথে আছে সিরামিক টাইলসের রূপায়ণ। প্রতিটি বাড়িই অন্দরবাটি এবং বহির্বাটিÑ এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশির ভাগ বাড়ির চার দিকের ঘেরাটোপের ভেতর আছে উন্মুক্ত উঠোন।
পানাম নগরীর পরিকল্পনাও নিখুঁত। নগরীর পানি সরবাহের জন্য দুই পাশে দু’টি খাল ও পাঁচটি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কূপ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছে খালের দিকে ঢালু। প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে সম্মানজনক দূরত্বে রয়েছে। নগরীর যাতায়াতের জন্য রয়েছে এর একমাত্র রাস্তা, যা এই নগরীর মধ্যখান দিয়ে বয়ে গেছে এ পাশ-ও পাশ।
নগরীর ভেতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর। এ ছাড়া আছে ৪০০ বছরের পুরনো টঁাঁকশাল বাড়ি। সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে রয়েছে গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। মসজিদটি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর শাসনামলে নির্মিত হয়। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা দিয়ে একটু দক্ষিণ দিকে গেলে রয়েছে আরো কিছু ইমারত, বারো আউলিয়ার মাজার, হজরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তার বংশধরদের মাজার, দমদম গ্রামে অবস্থিত দমদমদুর্গ ইত্যাদি। এ ছাড়াও নগরীর আশপাশে ছড়িয়ে আছে ঈশা খাঁ ও তার ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন, ফতেহ শাহের মসজিদ, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীরের মাজার, কদম রসুল, চিলেকোঠাসহ বহু পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ববহ স্থাপনা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলচাষের নির্মম ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে পানামের নীলকুঠি। পানাম পুলের কাছে দুলালপুর সড়কের পাশেই এর অবস্থান। জানা যায়, শুরুতে এটি কোম্পানির মসলিন বস্ত্র ক্রয়কেন্দ্রের দফতর ভবন হলেও পরে কুঠিটি নীল ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে ওঠে। যদিও বর্তমানে নীলকুঠির মূল রূপ ঢাকা পড়ে গেছে নতুন করে করা পলেস্তারার নিচে।
পঙ্খীরাজ খালের ওপর ১৭ শতকে এই পুল নির্মিত হয়েছিল, যা আমিনপুর ও দুলালপুর গ্রামের সংযোগ রক্ষা করছে। তিনটি খিলানের উপর পুলটি স্থাপিত। পুলের নিচ দিয়ে পণ্যবাহী নৌযান চলাচলের সুবিধা দিতে মধ্যখানের খিলানটি কিছুটা উঁচু করে বানানো। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে পুলটির সংস্কারকাজ চালানো হয়।
একবার পারস্যের খ্যাতিমান কবি হাফিজকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। বৃদ্ধ কবি হাফিজ সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আসতে না পেরে একটা গজল রচনা করে উপহার পাঠান সুলতানকে। এই গজলের সূত্র ধরেই ফার্সি এক পর্যটক এসেছিলেন সোনারগাঁওয়ে আর মুগ্ধ হয়েছিলেন পানাম নগরীর সৌন্দর্য দেখে।


আরো সংবাদ



premium cement
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা ফতুল্লায় ১০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্মাণকাজ বন্ধ, মারধরে আহত ২, মামলা পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনী: সাম্প্রতিক ভাবনা গফরগাঁওয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে টিকটক করতে গিয়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু তানজানিয়ায় বন্যায় ১৫৫ জনের মৃত্যু বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৩ দেশে কাতার আমিরের সফরে কী লাভ ও উদ্দেশ্য?

সকল