১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সোমপুর বিহার : ভুলে যাওয়া এক সভ্যতা

অনন্য স্থাপত্য
-

সোমপুর বিহারকে মনে করা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার। খুঁজে পাওয়া শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এর পুরো নাম শ্রী সোমপুর-শ্রী- ধার্মপালদেব-মহাবিহার-ভিক্ষু সঙ্ঘ। এটিই বাংলাদেশে অবস্থিত তিনটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে অন্যতম। বাকি দুটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হলো বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।
সোমপুর বিহারের অবস্থান বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত নওগাঁ জেলার, বদলগাছি উপজেলার, পাহাড়পুর ইউনিয়নে। তাই অনেকের কাছেই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নামে বেশি পরিচিত সোমপুর বিহার। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী প্রাচীন বঙ্গ জনপদে সুদীর্ঘ চার শতক রাজত্ব করেছিল পাল বংশ। মূলত বাংলা ও বিহারকেন্দ্রিক পাল রাজ্য, সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তর পশ্চিমে পাকিস্তানের খায়বার-পাখতুনখওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পাল বংশের রাজারা ছিলেন নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ। ধারণা করা হয় পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপালের সময়ই নির্মিত হয়েছিল সোমপুর বৌদ্ধবিহার। তবে অনেকে এও ধারণা করেন ধর্মপাল নন তার পুত্র রাজা দেবপাল ছিলেন এই বিহারের নির্মাতা কারণ, বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ ‘পাগ সাম জোন ঝাং’-এর লেখক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০) কর্তৃক সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দিরের উল্লেখ করেছেন। তবে যার সময়ই নির্মাণ হোক না কেন সোমপুর বিহার স্থাপত্য শিল্পে অনন্য এবং আকারে সুবৃহৎ।
মাটির ঢিবির নিচে দীর্ঘকাল চাপা পড়ে থাকা এই প্রকাণ্ড স্থাপনা দূর থেকে দেখলে পাহাড়ের মতোই মনে হতো। পাহাড়পুর ইউনিয়নের নামকরণ সেই থেকেই। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও সুদূর চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে বৌদ্ধরা আসতেন এখানে। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। মহাপণ্ডিত অতীশের জ্ঞানের সুখ্যাতি বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সুদূর তিব্বতে। প্রচলিত আছে তিব্বতে গিয়ে তিনি সেখানকার পানির সমস্যা সমাধান করে এসেছিলেন। এই মহান পণ্ডিতের বাড়ি ছিল ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে।
এক সময়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম সাধকদের জ্ঞানতীর্থ, এই বিহার মাটির নিচে চাপা পড়েছিল দীর্ঘকাল। মোটামুটি ৬০০ বছর স্মৃতির অতলে হারিয়ে থাকার পর পুনরায় এর হদিস মেলে ইংরেজ আমলে ভূমি জরিপের সময় ১৮০৭-১৮১২ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে। তারপর স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিমহাম ১৮৭৯-এর দিকে এবং ব্রিটিশ ভারতে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ১৯২০-এর দশকে আংশিক খননকাজ চালায়। অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০-র দশকে এর খননকাজ পুরোদমে শুরু হয় এবং ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রায় ২৭ একর জায়গাজুড়ে বিহারটি বিস্তৃত। এতে রয়েছে ১৭৭টি কক্ষ। মাঝখানে প্রকাণ্ড মন্দিরটিকেই মূলত দূর থেকে পাহাড়ের মতো দেখায়। এ মন্দিরের বেইসমেন্ট ক্রুশাকার। প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১০৮.৩ মি ও ৯৫.৪৫মি। মধ্যবর্তী স্থানে আরও কয়েকটি অতিরিক্ত দেয়াল কৌণিকভাবে যুক্ত এবং কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ আছে। এই প্রকোষ্ঠটি মন্দিরের তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলত এ শূন্যগর্ভ প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই সুবিশাল এ মন্দিরের কাঠামো নির্মিত। মন্দিরের বর্তমান উচ্চতা ২১ মিটারের মতো। তবে ধারণা করা হয় একসময় হয়ত ৩০ মিটারের বেশি ছিল এই মন্দিরের উচ্চতা। অবশ্য নওগাঁ এলাকার স্থানীয়দের মতে দিন দিন ডেবে যাচ্ছে মূল মন্দিরটি, আশির দশকে খননকাজ শুরুর সময়কার উচ্চতা নাকি এখনকার চেয়েও বেশি ছিল। মূল মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটার কাজ দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রকমের মূর্তির আদলে টেরাকোটাগুলো তৈরি করা হয়েছে।
মন্দিরটিকে ঘিরে চারদিকে ছিল কক্ষগুলো। ধারণা করা হতো দূর-দূরান্ত থেকে আগত তান্ত্রিক সাধক ও শিক্ষার্থী ভিক্ষুরা অবস্থান করতেন এই ঘরগুলোতে। কক্ষগুলোর দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৪.২৬ মিটার এবং প্রস্থ ৪.১১ মিটার। মূল মন্দিরকে বর্গক্ষেত্রের মতো বেষ্টন করে আছে কক্ষগুলো। উত্তর দিকে এক সারিতে ৪৫টি এবং বাকি তিন দিকে রয়েছে ৪৪টি করে। শুধু সোমনাথবিহার নয় পাল আমলে বাংলা ও বিহারে অনেক বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল। তিব্বতীয় বর্ণনা অনুসারে সে আমলে পাঁচটি বড় বড় বিহার যাদের মধ্যে সোমপুর একটি বাকি চারটি হল বিক্রমশীলা, নালন্দা, ওদান্তপুত্র এবং রাজশাহীর জগদ্দলবিহার। এই বিহারগুলোর পরস্পরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং অনেকটা এখানাকার দিনের মতো আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কো-লেবোরেশনের মতো।
বিহারটি আকস্মিক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় বাংলায় ক্ষীয়মাণ বৌদ্ধ শাসন, হিন্দুপ্রধান সেনবংশের উত্থান এবং সর্বোপরি তাদের হারিয়ে বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পর নব্য রাজনৈতিক পটভূমিকায় আস্তে আস্তে বিহারটি লোকশূন্য হতে হতে একসময় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সেটা প্রায় আজ থেকে ৮০০ বছর আগের কথা।


আরো সংবাদ



premium cement
বিদেশ যাওয়া হলো না আশরাফুলের, বাসচাপায় মামাসহ নিহত ‘সন্ত্রাসীদের ঘরে ঢুকে মারা’ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া মাতৃভূমি রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য : সেনাপ্রধান ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সাথে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ১ হাজার টাকার জন্য পেশাদার ছিনতাইকারীরা খুন করে ভ্যানচালক হারুনকে দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় : মতিউর রহমান আকন্দ টানা ১১ জয়ে ডিপিএলের প্রথম পর্ব শেষ করলো আবাহনী দেশে করোনায় আরো একজনের মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের অংশ নিতে মানা সবল-দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার কাজ শেষ হতে কত দিন লাগবে? জনগণের শক্তির কাছে আ'লীগকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল

সকল