১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আইন আছে মানছে না কেউ রাজধানীর যোগাযোগ-১০

-

ঢাকার সড়ক ব্যবহারকারী পরিবহন চালক কিংবা পথচারী সবার জন্য আইনকানুন আছে। কিভাবে রাস্তায় চলতে হবে, কোন রাস্তায় গাড়ির দূরত্ব কত হবে, রাস্তার মোড়ে গাড়ির স্পিড কত থাকবে, কোথায় হর্ন বাজানো যাবে, কোথায় যাবে না, গাড়ি চালানোর সময় চালকদের সিটবেল্ট বাঁধতে হবেÑ মোটরযান আইনে এরকম নিয়মসংবলিত ১৭৭টি ধারা-উপধারা আছে। কিন্তু গাড়ি চালানোর জন্য গদবাঁধা কিছু আইন জানা থাকলেও চালকেরা তা কোনোভাবেই মানতে চান না। ভিআইপিদেরও আইন ভাঙার প্রবণতা লক্ষণীয়। সুযোগ পেলেই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করছে সব পক্ষই। ফুট ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে পথচলা, উল্টোপথে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, সিটবেল্ট না বাঁধা, ফুটপাথ দিয়ে যানবাহন চালানোÑ এসব এখন নিত্যদিনের চিত্র।
গত শনিবার এক ভিডিও কনফারেন্সে চালক ও পথচারীরা সড়কে নিয়ম মেনে না চলায় আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় দোষটা হচ্ছে তারা ট্রাফিক আইন মানেন না। দয়া করে আপনারা রাস্তার নিয়মগুলো মেনে চলবেন। তাহলে দুর্ঘটনা কমে যাবে। সড়ক দুর্ঘটনা হলে কার দোষে তা হয়েছে, তা সঠিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ২৯ জুলাই হোটেল রেডিসনের সামনে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসের চাপায় নিহত হওয়ার পর দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিশুরা রাস্তায় নেমে আসে। দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা শিশুদের আন্দোলন চলাকালে সড়কে শৃঙ্খলাও ফিরে এসেছিল। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আসে ১৭টি নির্দেশনা। সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন। কিন্তু এখন সেই আগের অবস্থায়ই ফিরেছে যানবাহন বা পথচারীরা। প্রথম কয়েক দিন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানলেও বর্তমানে সেগুলো অবজ্ঞা করছে সব পক্ষই। নির্দেশনার মধ্যে ছিলÑ বাসের দরজা বন্ধ ও স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামায় নিষেধাজ্ঞা, বাসে দৃশ্যমান দু’টি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর প্রদর্শন, চালক ও যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার এবং পরিবহন মালিকদের সিটবেল্ট সংযোজন, যেসব সড়কে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে সেসব স্থানের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপারে নিষেধাজ্ঞা। তবে এগুলোর কোনোটিই মানছেন না বাসচালক-মালিক কিংবা পথচারীরা। গত এক সপ্তাহ পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, ফার্মগেট, সায়ন্স ল্যাব, গাবতলী, শ্যামলীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আইন না মানার নানা সংস্কৃতি চোখে পড়ে। বাসচালক নজরুল ১০ বছর ধরে বাস চালালেও সিটবেল্ট পরা তো দূরের কথা, কখনো বাসে সিটবেল্ট দেখেননি তিনি। তিনি জানান, কোনো গাড়িতেই সিটবেল্ট থাকে না। সিটবেল্ট থাকলে পরব। প্রাইভেট কার চালক সুমন জানান, ঢাকা শহরের গাড়ি চলে ধীরে ধীরে। সিটবেল্ট বাঁধা লাগে না। এরকম নিয়ম না মানার প্রবণতা অহরহ। জরিমানা গুণেও থামানো যাচ্ছে না।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ২৬ লাখ ৩১ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা করেছে পুলিশ। ট্রাফিক আইন অমান্য করার অভিযোগে ৫ হাজার ৪৬২টি মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৪টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৪৭৪টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন রাস্তায় চলছে। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ যানবাহনের চলাচলের ফিটনেস, পারমিট বা নিবন্ধন নেই, বা ভুয়া নম্বরে চলছে এসব যানবাহন। সারা দেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএর লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখ চালকের হাতে। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। ফলে এসব বাসে দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা, বা কারো জীবন চলে যাচ্ছে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, সড়কে প্রতিনিয়ত আইন ভঙ্গ করছেন চালকেরা। অধিকাংশ চালকই জানেন না সড়কে গাড়ি চালানোর নিয়মকানুন। তাই চালক তৈরির এ প্রক্রিয়া পাল্টাতে হবে। বেসরকারি ট্রেনিং সেন্টারগুলোর প্রশিক্ষণ পদ্ধতির বিষয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে।
ট্রাফিক ঢাকা দক্ষিণ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন) কামরুন নেছা নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজধানীতে মোটরযান চলাচলের জন্য ১৭৭টি ধারা আছে। সেগুলো খাতা কলমেই আছে। অনেকেই জানেন, অনেকেই জানেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইন না মানার কারণে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আইন মানার জন্য মানসিকতা থাকা উচিত। সচেতন হওয়া জরুরি।
জানতে চাইলে বুয়েটের এআরআই ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো: সাইফুন নেওয়াজ বলেন, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো এখনো চলছে, রেষারেষি বন্ধ হয়নি। গণপরিবহন ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে গড়ে ওঠেনি। বাস কোম্পানিগুলো যাত্রী পেতে সড়ক আটকে রেখে প্রতিযোগিতা করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। পথচারীরাও পথ চলার ক্ষেত্রে কোনো আইন মানতে চায় না। সবাইকেই সচেতন হওয়া দরকার।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন নয়া দিগন্তকে বলেন, শুধু ঢাকা নয়, দেশের কোনো রাস্তা নিরাপদ নয়। গাড়ির পারাপারি এখনো চলছে। পথচারী মোবাইল ফোন কানে দিয়ে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছে। ফুটওভারব্রিজ থাকলেও পথচারীরা ঠিকমতো ব্যবহার করছে না। আইন না মানার কারণে, সচেতন না হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু গাড়িচালক নন, পথচারী থেকে শুরু করে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাহলে সড়কে শৃঙ্খলাও ফিরে আসবে, দুর্ঘটনাও কমে যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement