২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ডাকসু নির্বাচনে বিপর্যয়

ছাত্রদলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ

-

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংগঠন গোছাচ্ছে বিএনপি। বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নতুন আহ্বায়ক কমিটি করা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে এবার ছাত্রদলকেও ঢেলে সাজাতে চায় বিএনপি। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি। বলা হয়Ñ ছাত্রদলে যারা যুক্ত হন পরে বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে তারাই বিএনপির মূল রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পর্যায়ক্রমে দল ও দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে বিএনপির যারা নীতিনির্ধারক তাদের অনেকেরই রয়েছে সোনালি অতীত। একসময় ছাত্রদলের হয়ে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সরব। অনেকেই রাজনীতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নামও লিখিয়েছেন। কিন্তু আজকে ছাত্রদলের করুণ অবস্থা। গত ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (ডাকসু) কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি সংগঠনটি। এজন্য অবশ্য বর্তমান শীর্ষ দুই নেতাকেই দুষছেন নিচু সারির নেতারা ও বিএনপির হাইকমান্ড। প্রায় ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ছাত্রদল প্রথমে তাদের প্যানেল চূড়ান্ত করতেই হিমশিম খায়। একপর্যায়ে কয়েকজন নেতা ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে নিজেদের অনুসারীদের সমন্বয়ে প্যানেল চূড়ান্ত করেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ছাত্রদলের অভ্যন্তরে আশার আলো ফুটলেও তেমন কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেনি সংগঠনটি। এমতাবস্থায় ছাত্রদলের সোনালি অতীত আর গৌরব ফিরিয়ে আনতে দ্রুত ছাত্রদলের নতুন কমিটি দেয়ার কাজ শুরু করেছে বিএনপি। তবে কোন লেভেলের নেতাদের নিয়ে কমিটি হবে তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। সংগঠনের অনেকেই চান একেবারে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়া হোক। আবার একটি গ্রুপ চায় আহ্বায়ক কমিটি। যারা একটি কাউন্সিল আয়োজনের মাধ্যমে নতুনদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নিতে চান। কেউ চান একেবারে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন। এ নিয়েই এখন ছাত্রদল ও বিএনপিতে মতানৈক্য। ডাকসু নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরই ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন নিয়ে ব্যাপক তৎপর বিএনপি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর রাজীব আহসানকে সভাপতি ও মো: আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের ১৫৩ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বর্তমান কমিটির বেশির ভাগ নেতার ছাত্রত্ব না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এই কমিটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বর্তমানে ভেঙে পড়েছে ছাত্রদলের চেইন অব কমান্ড। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির কারণে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে সংগঠনের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে। বাড়ছে গ্রুপিং-কোন্দল আর ক্ষোভ। এমনকি নতুন কমিটির দাবিতে কেন্দ্রীয় বহু নেতা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের প্রতি অনাস্থাও জানিয়েছেন। সংগঠনের নেতা আলমগীর হাসান সোহান ও গোলাম মোস্তফা বলেন, ছাত্রদলের নতুন কমিটি এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে বেগবান করতে ছাত্রদলকেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় ১০ বছর ধরে ছাত্রদলের প্রকাশ্য কার্যক্রম ছিল বন্ধ। তবে সদ্য অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রদল ঢাবিতে নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছে। নির্বাচনে কোনো অবস্থান না থাকলেও এখন প্রায় প্রতিদিনই মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে আড্ডার পাশাপাশি ক্যাম্পাস রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করছেন।
ছাত্রদলের কাণ্ডারি হতে দৌড়ঝাঁপ : ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে শীর্ষ পদের জন্য অনেকেই দৌড়ঝাঁপ করছেন। যাদের নাম বেশি আলোচিত তাদের সাথে ছাত্রদলের তৃণমূল এবং বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক যোগাযোগ ভালো বলে জানা গেছে। শীর্ষ পদের জন্য আলোচনায় আছেন কেন্দ্রীয় নেতা (নিচের দিক থেকে) আসাদুজ্জামান আসাদ, আবুল হাসান, নূরুল হুদা বাবু, মফিজুর রহমান আশিক, বায়েজিদ আরেফিন, গোলাম মোস্তফা, মিয়া মো: রাসেল, কাজী মোকতার হোসেন, মির্জা ইয়াসিন আলী, রাজিব আহসান পাপ্পু, মিনহাজুল ইসলাম ভূঁইয়া, আব্দুর রহিম অন্যতম। সিনিয়রদের মধ্যে নাজমুল হাসান, আলমগীর হাসান সোহান, এজমল হোসেন পাইলট, মামুন বিল্লাহ, আব্দুল ওহাব, আবু আতিক আল হাসান মিন্টু, জহিরুল ইসলাম বিপ্লব প্রমুখ। এদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে জেল খেটেছেন। অসংখ্য মামলা নিয়ে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে এখনো সক্রিয়। বিএনপির হাইকমান্ড ও তারেক রহমান তাদের চেনেন। শীর্ষ পদপ্রত্যাশী গোলাম মোস্তফা বলেন, হলের রাজনীতি থেকে শুরু করে দলের এ পর্যন্ত এসেছি। বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ব্যাপক নির্যাতিত হয়ে ১১ দিন রিমান্ড খেটেছি। খালেদা জিয়ার শেষ হাজিরার দিনে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছি। সব সময় দলের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব। আশা করি দল আমার ত্যাগ-তিতীক্ষা মূল্যায়ন করবে। নূরুল হুদা বাবু বলেন, যেভাবেই হোক এই মুহূর্তে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিলেই ভালো। আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ছাত্রদলের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র সংগঠনের নতুন কমিটি দেয়াটা এখন সময়ের দাবি। নতুন কমিটি হলে সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ও কার্যক্রমে গতি আসবে। মিয়া মো: রাসেল বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্রদলের নতুন কমিটি দেয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক। তবে সবকিছু বিবেচনায় দ্রুত একটি সময়োপযোগী নতুন কমিটি চান নাজমুল হাসান।
ডাকসু নির্বাচনে বিপর্যয় : ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের বিপর্যয়ের পর এর নেপথ্য অনুসন্ধানে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বিএনপির হাইকমান্ডও আশ্চর্য। এত ভরাডুবির কারণ কী? তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের মূল বিপর্যয়ের কারণ হচ্ছে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ডাকসু প্যানেলে ‘অপরিচিত’ মুখ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং এবং ক্যাম্পাস ভিত্তিক কর্মসূচি না থাকা। যে কারণে প্রথম দিকে ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে দো-টানায় ছিল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে একাধিক উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ছাত্রদলের সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র নেতারা। অবশেষে তারেক রহমানের নির্দেশে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং হল সংসদে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল নির্ধারণ করতে হিশশিম খায় ছাত্রদল। ডাকসুতেও একুশ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্যানেল এবং হল সংসদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। তবে মেয়েদের পাঁচটি হলে একক প্যানেল দিতে পারেনি ছাত্রদল। হাতেগোনা কয়েকজন প্রার্থী হল সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। প্রায় এক দশক ধরে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল প্রকাশ্যে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেনি। ছাত্রলীগের একাধিপত্যের কাছে ধরাশায়ী সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বহু নেতাকর্মীকে মারধরের পর থানায় সোপর্দ করে ছাত্রলীগ। এভাবে প্রায় দশ বছরে ক্রমান্বয়ে নানাভাবে হল ছাড়া হতে থাকেন ছাত্রদলের নেতাকর্মী-সমর্থকেরা। এসব ঘটনায় ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে কোণঠাসা ছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এর ব্যর্থতার দায় কেউ এককভাবে নিতে চান না।
সূত্র জানায়, ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে অপেক্ষাকৃত কম বয়স্কদের রাখার পরিকল্পনা বিএনপি হাইকমান্ডের। এ ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতাদের বয়সসীমা কমিয়ে যারা ২০০০-২০০১ (অনার্স) সেশনের তাদের মধ্য থেকেই নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে। যদিও এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে খুব দ্রুত ছাত্রদলের একটি সময়োপযোগী নতুন কমিটি গঠন করা হবে। যেখানে ঠাঁই পাবেন ত্যাগী, পরীক্ষিত ও যোগ্যরা। বাদ পড়াদেরকে বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে পদ দেয়া হবে বলে জানা গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement