২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমা

বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মুনাজাতে অংশ নেন লাখো মুসল্লি :নয়া দিগন্ত -

মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহলৌকিক ও পরকালীন মুক্তি কামনায় আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৫৪তম বিশ^ ইজতেমা। মাওলানা সাদপন্থীদের এ ইজতেমার আখেরি মুনাজাত ছিল অত্যন্ত আবেগঘন ও কান্নাজড়িত কণ্ঠের। মুনাজাত পরিচালনাকালে ভারতের মাওলানা মুহাম্মদ শামীম অঝোরে কেঁদেছেন; এ সময় তাবলিগ সাথীরাও কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। কান্নার আওয়াজে ইজতেমার মূল ময়দানজুড়ে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুনাজাতের আগে তাবলিগ সাথীদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক ও সমাপনী বয়ানে তিনি বলেন, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে কেউ যদি আমাদের গালি দেয় বা চলাফেরার পথে আমরা যদি অত্যাচারের শিকার হই; তাহলে আমরা প্রতিশোধ না নিয়ে বরং ক্ষমা করে দেবো এবং মহান আল্লাহর হেদায়েত প্রার্থনা করব। আজকে যারা না বুঝে দুশমনি করছেন তাদেরকে যেন আল্লাহ হেদায়েত দান করেন। তিনি বলেন, দুনিয়ার মধ্যে কোনো মানুষ আমাদের দুশমন না। মহান আল্লাহ আমাদের দুশমনকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। শয়তান ও নফস আমাদের শত্রু। এই শত্রুকে আল্লাহ চিহ্নিত করেছেন। যারা শয়তানের পরোচনায় দুশমনি করতে চায় তাদেরকে মহান আল্লাহ আমাদের বাধ্য করে দেবেন। আল্লাহর রাস্তা একটি পবিত্র রাস্তা। এই রাস্তার পথিকদেরকে শয়তান খায়েশি নফস দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারে না। চাহিদার মনোযোগ বাড়িয়ে দিয়ে শয়তান সেখান দিয়ে প্রবেশ করে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকলে শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকা যায়। আল্লাহর রাস্তায় চলার পথে শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকতে পারলে আল্লাহ আমাদেরকে তার অলি বানিয়ে দেবেন।
মাওলানা মুহাম্মদ শামীম সকাল ৯টা ৩৪ মিনিটে সমাপনী বয়ান শুরু করেন। এর পর সমাপনী বয়ানের পর বেলা ১১টা ৪৬ মিনিটে দুরূদ শরিফ পাঠের মধ্য দিয়ে আখেরি মুনাজাত শুরু করেন। মুনাজাত শেষ করেন ১২টা ২ মিনিটে। মুনাজাতের প্রথম ৮ মিনিট কালামে পাক থেকে দোয়ার আয়াতগুলো উদ্ধৃত করে আরবিতে মুনাজাত করেন। এর পর উর্দু ভাষায় মুনাজাত পরিচালনা করেন। তার আবেগঘন এই মুনাজাত চলাকালে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকায় নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। লাখো মুসল্লি মহান আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে আল্লাহুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন বলে চোখের পানি ছেড়ে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ সময় লাখো মানুষের কান্নায় গোটা ইজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিশ^ তাবলিগ জামাতের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ অবশেষে শান্তিপূর্ণভাবেই সমাপ্ত হয়েছে।
গতকাল দ্বিতীয় দফায় আখেরি মুনাজাতে শরিক হতে তাবলিগ সাথীদের পাশাপাশি গাজীপুরের বিভিন্ন উপজেলা এবং ঢাকাসহ আশপাশের জেলা থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ভোর থেকেই ইজতেমা ময়দানে বিভিন্ন যানবাহন ও পায়ে হেঁটে আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে দলে দলে আসতে থাকেন। অনেকে আবার ইজতেমা ময়দানে গিয়ে তাবলিগ সাথীদের সাথে খিত্তায় খিত্তায় অবস্থান নেন। আবার অনেকেই ইজতেমার বিশাল শামিয়ানার নিচে ঠাঁই না পেয়ে ময়দানের পাশর্^বর্তী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়ক, আশুলিয়া-সাভার সড়ক, কামারপাড়া রোড, বাটা রোডসহ বিভিন্ন অলি-গলি, আশপাশের বাসা-বাড়ি ও যানবাহনের ছাদে পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে অবস্থান নিয়ে আখেরি মুনাজাতে অংশ নেন।
তাবলিগ জামাতের মুরব্বি প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, গতকাল মঙ্গলবার বাদ ফজর থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা হাফেজ ইকবাল নায়ার। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশী মাওলানা ওসামা বিন ওয়াসিফ। তিনি হেদায়েতি বয়ানে বলেন, দ্বীন ইসলামের বিধান অনুসারে চলবে। যে ব্যক্তি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করবে সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করবে। ঈমানকে শক্তিশালী করতে হলে মানুষকে মসজিদের পরিবেশে বসাতে হবে। মুসলমানের নামাজ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। নামাজ এমনভাবে আদায় করতে হবে, যেমন নবী করিম সা: আদায় করেছেন। জবরদস্তি করে নয়, তাজিমের সাথে বুঝিয়ে কাউকে মসজিদে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহকে রাজি ও খুশি করার জন্যই করতে হবে। নামাজ সব গুনাহ থেকে বিরত রাখে। সহিহভাবে নামাজ আদায় শিখতে হবে। নামাজের দরকারি সূরাগুলো সহিহ-শুদ্ধভাবে শিখতে হবে।
এবারের বিশ^ ইজতেমাকে নিয়ে বিভিন্ন মহল মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তাদের মতে ৫৪তম বিশ^ ইজতেমাকে কেন্দ্র করে মাওলানা জোবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্দলভি এই দু’পক্ষের মতবিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোর মতো সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং শুধু আল্লাহর রাহে হেদায়েতি সংগঠনটিও অবশেষে বিভক্ত হয়ে গেল। বিশ^ তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি হজরত মাওলানা সাদ কান্দলভির এক বয়ানকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ দ্বন্দ্ব এবারের বিশ^ ইজতেমা অনুষ্ঠানে আগের নিয়মমাফিক জোড় ইজতেমায় এসে দু’গ্রুপের মতবিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের বিশ^ ইজতেমার প্রস্তুতি কার্যক্রম চালাতে গিয়ে দু’গ্রুপ বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এ সময় দুইজন তাবলিগ সাথী নিহতসহ কয়েকশত তাবলিগ অনুসারী আহত হন। বন্ধ হয়ে যায় পূর্বনির্ধারিত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ^ ইজতেমা। পরে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও কিছু সময় বিলম্বিত হয়। এরপর সরকারের হস্তক্ষেপ এবং দু’গ্রুপের সাথে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কয়েক দফায় আলোচনার পর দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে বিশ^ ইজতেমা আয়োজনে সম্মত হয়। এ থেকে শুধু দ্বীনের দাওয়াতি কাজে মেহনতকারী বিশ^ তাবলিগ জামাত সংগঠনটি ভেঙে জোবায়ের পন্থী এবং সাদ পন্থী এই দু’গ্রুপে বিভক্ত হয়। এমতাবস্থায় এক মাস পিছিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জোবায়ের গ্রুপ এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গতকাল মঙ্গলবার ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ৫ দিন বিশ^ ইজতেমার কার্যক্রম চলে। জোবায়ের পন্থীদের বেঁধে দেয়া দুই দিন সময়ে ইজতেমার কাজ শেষ করলেও ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বৈরী আবহাওয়া ও বৃষ্টি থাকায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একদিন সময় বাড়িয়ে সাদপন্থীদের ইজতেমা ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়।
সাদপন্থীদের ২০২০ সালের বিশ্ব ইজতেমা
মাওলানা সাদপন্থীদের আয়োজনে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে আগামী বছরের (২০২০ সালের) ৩, ৪ ও ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমার মূল নজমের জামাতের সদস্য মো: হারুন-অর-রশিদ প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য ওই তারিখ নির্ধারণ করেছেন। এ ছাড়াও চলতি বছরের ২২ হতে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী মাওলানা সাদ অনুসারীদের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে।
আর ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মুনাজাতের পর শনিবার মাইকে জোবায়েরপন্থীরা ২০২০ সালের ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী তাদের আগামী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দফা ২০২০ সালের ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি এবং ২য় দফা অনুষ্ঠিত হবে ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি। আর তাদের পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে ২০১৯ সালের ২৯ ও ৩০ নভেম্বর এবং ১, ২ ও ৩ ডিসেম্বর।
এ দিকে তাবলিগ জামাতের অপর পক্ষ মাওলানা জোবায়ের অনুসারীরা তাদের বিশ্ব ইজতেমার তারিখ আগামী বছরের (২০২০ সালের) ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি প্রথম দফা এবং ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফা টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে অনুষ্ঠিত বলে ঘোষণা দেন। এ ছাড়াও তাদের ৫ দিনের জোড় ইজতেমা চলতি বছরের (২০১৯ সাল) ২৯ ও ৩০ নভেম্বর এবং ১, ২ ও ৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ঘোষণা দেন। এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্যায়ে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ইজতেমার আখেরি মুনাজাত শেষে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) জোবায়েরপন্থীরা এ ঘোষণা দেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement