১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্থাপত্যশৈলীর পুরাকীর্তি স্যার পিসি রায়ের বাড়ি

অনন্য স্থাপত্য
-

খুলনার পাইকগাছার কপোতাক্ষ নদের তীরে ছায়া সুনিবিড় সবুজে ঘেরা রাড়–ুলী গ্রাম। এই গ্রামেই জন্মেছিলেন বিশ্ববরেণ্য বাঙালি বিজ্ঞানী রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ১৮৫০ সালে প্রফুল্লচন্দ্রের বাবা জমিদার হরিশচন্দ্র রায় রাড়ুলী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বসতবাড়িটি নির্মাণ করেন। দুইভাগে বিভক্ত করে বানানো বাড়ির একটি হলো সদর মহল, আরেকটি অন্দর মহল। দোতলা ভবনটার পুরোটাই অন্দর মহল। এটা বাড়ির নারীদের বসবাসের জন্য বানানো। আর সদর মহল গ্রামের প্রধান সড়ক ঘেঁষে।
দক্ষিণমুখী মূল বাড়িতে ঢুকলেও প্রথমে চোখ পড়বে পূর্বদিকের শানবাঁধানো প্রাচীন পুকুরটির পর অন্দর মহলেই। এই ভবনটা বানানো হয় মূল সদর মহলেরই মতো মুসলিম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে। এর প্রথম তলার বারান্দায় খিলান ও দ্বিতীয় তলার বারান্দায় গোলাকার জোড়া খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে। অন্দর মহলের পেছনটায় এখন সাবপোস্ট অফিস। বাড়ির সামনে রঙিন পাথরে খচিত পিসি রায়ের প্রতিমূর্তি। অন্দর মহলের সামনে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে এলে হাতের বাঁয়ে তারকাঁটার বেড়ার দরজা ঠেলে সদর মহলের মূল দরজা। সাড়ে ৬ হাত লম্বা শক্ত কাঠের এ দরজা পেরুলেই মূল জমিদার বাড়ি। বড় উঠানে দাঁড়ালে হাতের বাঁদিকে দোতলা বাড়ি, নাক বরাবর সামনে ঠাকুর ঘর, ডানপাশে ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির একতলা ভবন। যেটা দরজার জায়গা রেখে আবার পেছনের দিক দিয়ে দোতলা ভবনের সঙ্গে মিলেছে। হাতের ডান দিকে যে একতলা ভবন সেটার সামনেই পুরো বাড়ির আঙিনা। বাড়ির সামনে রঙিন পাথরে খচিত পিসি রায়ের প্রতিমূর্তি। আর দরজার দু’দিকে বাড়িটি নির্মাণ ও সংস্কারসংক্রান্ত তথ্যাদি লেখা দু’টি ফলক। মূল ভবনের ছাদের ওপর একটি সিংহমূর্তি। প্রায় ১৭০টি স্তম্ভের ওপর বসানো পুরো কমপ্লেক্সটিতে মোট ৪৫টি দরজা ও ১৩০টি জানালা। নকশা করা স্তম্ভ আর দেয়ালে দেয়ালে ফুল ও লতাপাতার বাহারি সব কারুকাজ।
১৮৬১ সালের ২ আগস্ট জন্ম নেয়া চিরকুমার প্রফুল্লচন্দ্র তার মৃত্যুর আগে জীবনের অর্জিত সব সম্পত্তি মানবকল্যাণে দান করে যান। ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন তার জীবনাবসান হলে বাড়িটি কয়েক দফায় পরিত্যক্ত ও উদ্ধার হয়। প্রফুল্লচন্দ্রের ৫ ভাই ও ভাতিজারা ভারতে থাকেন বলে স্বজনদের পক্ষ থেকেও এই বাড়ির খোঁজ রাখছিলেন না কেউ। সবশেষে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলের কাছ থেকে ১৯৯৫ সালে এ বাড়ি উদ্ধারের পর পুরাকীর্তি ঘোষণা করে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। অন্দর মহলটার খোঁজ কেউ না নিলেও পৌনে ৪ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা মূল বাড়িটাকে পুরাকীর্তি ঘোষণার মাধ্যমে সংরক্ষণ করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। যদিও জমিদার বাড়িটার সীমানা সব মিলিয়ে ২১ বিঘা।
পুরাকীর্তি ঘোষিত অংশের ‘সাইট পরিচালক’ হিসেবে কাজ করছেন তপনচন্দ্র দত্ত। ৯ বছর ধরে পুরো বাড়িটা একা দেখভাল করছেন তিনি। থাকেন মূল বাড়ির ভেতরের একটি কক্ষেই। ভাঙাচোরা ইট-কাঠ-দরজা-জানালা পড়ে আছে যে কক্ষে, সেই কক্ষেই প্রথম চোখ মেলে হেসেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তপনচন্দ্রের সঙ্গে আলাপে বোঝা গেল, অন্দর মহলটাও পুরাকীর্তির মধ্যে আনা দরকার।
এই গ্রামেরই একজন হরেকৃষ্ণ দাস। কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, পিসি রায় আমাদের গর্ব। তার বাড়িকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন থাকলে তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। বছরে নামকাওয়াস্তে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করেই শেষ। তারপর আর কোনো খোঁজ থাকে না। অথচ দেশী-বিদেশী অনেক পর্যটক এখানে আসেন বিশ্ববরেণ্য এই মানুষটির স্মৃতিঘেরা বাড়িটি দেখতে।
পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট স ম বাবর আলী বলেন, ফাদার অব নাইট্রাইট খ্যাত বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আচার্য পিসি রায়ের ভিটেবাড়ির ভবনগুলো আজো অযতœ-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। বসতবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বসতভিটা ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র ও জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের। কিন্তু আজো তা পূরণ হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল