২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চাঁদপুরের ঐতিহ্য রূপসা জমিদারবাড়ী

অনন্য স্থাপত্য
-

প্রায় আড়াই শ’ বছরের পুরনো রূপসা জমিদারবাড়ী চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার উত্তর রূপসা ইউনিয়নে অবস্থিত। রূপসা গ্রামের বাজারে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এ স্থাপনা। এর ইতিকথা অনেকেই জানে না। বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শুনেছি, প্রায় সব জমিদারই ছিলেন প্রজা নিপীড়নকারী ও অত্যাচারী; কিন্তু রূপসার জমিদারেরা ছিলেন পরোপকারী। মানুষের আপদে-বিপদে তারা ছুটে যেতেন। বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের হাত।
রূপসা বাজারের পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে নজর দিলেই চোখে পড়বে ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ীর দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার। এ প্রবেশদ্বারের উপরে লেখা রয়েছে রূপসা জমিদারবাড়ী। প্রবেশদ্বার দিয়ে কয়েক কদম এগোলেই হাতের ডান পাশে পড়বে পুরনো কারুকাজ খচিত মসজিদ। মসজিদের দিকে তাকালেই নয়ন জুড়িয়ে যায়। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে জমিদার বংশের লোকজনের কবর। কবরগুলোতে রয়েছে ফলক। প্রতিটি ফলকে জমিদারদের কীর্তির বর্ণনা লেখা রয়েছে। জমিদারবাড়ীর ভেতরে রয়েছে বেশ ক’টি ছোট-বড় মঠ। রূপসা উত্তর ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে জানা যায়, রূপসা জমিদারবাড়ীটি প্রায় আট একর জমির উপর অবস্থিত।
প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে রূপসার খাজুরিয়া এলাকা সিংগেরগাঁও নামে পরিচিত ছিল। সেখানে বাইশ সিংহ পরিবার নামে একটি হিন্দু পরিবার বসবাস করত। সেই পরিবারের জমিদারির পরিসমাপ্তি ঘটলে আহম্মদ রাজা চৌধুরী রূপসা জমিদারবাড়ীতে জমিদারি শুরু করেন। তার পর এ জমিদারির দায়িত্ব এসে পড়ে মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর ওপর। উনিশ শতকের প্রথমভাগে মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী এই জমিদার পরিবারের পত্তন করেন। তিনি ছিলেন দানশীল ব্যক্তি। তিনি এলাকার অসহায়দের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তার মৃত্যুর পর জমিদার হন তার ছেলে আহমেদ গাজী চৌধুরী।
প্রকৃত অর্থে আহমেদ গাজী চৌধুরীর সময়কালেই এ জমিদার পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিস্তৃতি ঘটে। তিনি ছিলেন খুবই ধর্মানুরাগী। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারকল্পে তিনি অকৃপণভাবে অনুদান প্রদান করতেন। রূপসার সুপ্রাচীন জামে মসজিদ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখনো জমিদারবাড়ীতে প্রবেশের সিংহদ্বারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তা ছাড়া তিনি আরো মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু তাই নয়, রূপসা আহম্মদিয়া উচ্চবিদ্যালয়, আহম্মদিয়া সিনিয়র মাদরাসা, লাউতলী দিঘি তার কর্মের উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। আহমেদ গাজী চৌধুরী ছিলেন খুবই দয়ালু আর দানশীল ব্যক্তি। জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যে তিনি জমিও দান করেছেন।
আহমেদ গাজী সিলেটের হবিগঞ্জের লস্করপুরের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারে বিয়ে করেন। তার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তার ছিলো পাঁচ মেয়ে। তাদের মধ্যে চারজন মারা গেলে তার দ্বিতীয় মেয়ে তহুরুন্নেছা চৌধুরানী জমিদারির উত্তরাধিকারী হন। নারী হয়েও তিনি জমিদারি পরিচালনায় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এ জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তহুরুন্নেছাকে ‘কায়সায়ে হিন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করে। বর্তমান হবিগঞ্জের দাউদ নগরের জমিদার সৈয়দ শাহ কেরামত উল্যাহর ছেলে সৈয়দ হাবিব উল্যাহর সাথে তহুরুন্নেছার বিয়ে হয়। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। বিয়ের পর তহুরুন্নেছা রূপসায় থাকতেন। তার স্বামী সৈয়দ হাবিব উল্যাহ তহুরুন্নেছার জমিদারি দেখভাল করতেন। তহুরুন্নেছা নিজেকে সমাজসেবায় নিয়োজিত রেখেছিলেন।
তহুরুন্নেছার একমাত্র মেয়ের অকাল মৃত্যু হলে তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। এর কয়েক বছর পর তার স্বামী সৈয়দ হাবিব উল্যাহও মারা যান। এরপর জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এই দম্পতির একমাত্র ছেলে সৈয়দ আব্দুর রশিদ চৌধুরী। তিনি রূপসায় রসু চৌধুরী নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন আর ১৯৮১ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি কলকাতায় শিক্ষাজীবন শেষ করে জমিদারি শুরু করেন। আব্দুর রশিদ চৌধুরী ৭৪ বছর রূপসায় জমিদারি করেছেন। তিনি কুমিল্লার লাকসামের মনীষী নবাব ফয়জুন্নেছার পরিবারের সৈয়দ গাজীউল হকের মেয়ে সৈয়দা আমিরের নেছাকে বিয়ে করেন। আব্দুর রশিদের আমলে জমিদারি অনেক বিস্তার লাভ করে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার অবদান ছিল অনেক। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের স্থানীয়পর্যায়ের নেতাও ছিলেন তিনি।
রূপসা জমিদারবাড়ীতে প্রবেশের প্রধান ফটকের সামনের পানের দোকানি এক প্রবীণ ব্যক্তি একসময় জানিয়েছেন, রশিদ চৌধুরীর আমলে বহিরাগত লোকজন রূপসা বাজারে টোকেন ছাড়া প্রবেশ করতে পারত না। জানা যায়, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশের বিভিন্ন জেলায় জমিদারদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলেও রূপসার জমিদার রশিদ চৌধুরীর সম্পত্তি নিতে পারেননি। আইয়ুব খান রূপসায় এসে রশিদ চৌধুরীর সাথে বৈঠক করেন। তখন রশিদ চৌধুরী তাকে বলেছিলেন, আপনি আমার কাছে কী চান? জমিদারির সম্পত্তি না অন্য কিছু? আইয়ুব খান কোনো কথার জবাব দিতে পারেননি। ব্যর্থ হয়ে রূপসা থেকে ফিরে গেছেন।
রশিদ চৌধুরী এ এলাকার মানুষকে চলাচলের জন্যে ফসলি জমি আইল নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তখন গ্রামবাসী সে পথেই চলাচল করতেন। রশিদ চৌধুরী বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার দানশীলতা, দয়ার কথা আজো এলাকাবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময় তিনি ৩০-৪০টি গরু জবাই করে এলাকাবাসীর মধ্যে গোশত বিতরণ করতেন। গ্রামবাসী ও প্রজাদের কখনোই জমিদার রশিদ চৌধুরীর রোষানলে পড়তে হয়নি। তিনি মুসল্লিদের জন্যে রূপসা এলাকার প্রতিটি বাজারে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়া মন্দিরের জন্য তিনি জমি দান করেন। চাঁদপুর শহরের চৌধুরী জামে মসজিদ ও চৌধুরী ঘাটটি এ বাড়ির জমিদারদের অবদান।
১৯৮১ সালের ১৭ জুলাই রশিদ চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়। রশিদ চৌধুরীর দুই স্ত্রীর ঘরে আট ছেলে, ছয় মেয়ে রয়েছে। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছোট ছেলে মো: আলমগীর হোসেন চৌধুরীবাড়িতে বসবাস করছেন। রশিদ চৌধুরীর নাতি সৈয়দ মেহেদী হাছান চৌধুরী পারিবারিক ঐতিহ্য অক্ষুণœ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


আরো সংবাদ



premium cement