২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দু’টি আসনে আ’লীগ-বিএনপি অন্যটিতে ত্রিমুখী লড়াই

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১, ২ ও ৩ আসন
-

সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনেই বিএনপি প্রার্থীদের প্রাধান্য। তবে সবটিতেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র হয়েও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনে জামায়াতের প্রার্থী সাড়া ফেলেছেন। এখানে রয়েছে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা।
চারটি পৌরসভা ও ৪৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংসদীয় আসন তিনটি। এর মধ্যে একটি উপজেলা ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত হয়েছে ৪৩ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ); দুইটি পৌরসভা ও তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে ৪৪ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) এবং ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত হয় ৪৫ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৩ জন প্রার্থী। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনে চারজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে তিনজন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল (নৌকা), বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা (ধানের শীষ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মনিরুল ইসলাম মনিউর (হাতপাখা) ও বিএনএফের নূরুল ইসলাম জেন্টু (টেলিভিশন)।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসনে ভোটের লাড়াই শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মু. জিয়াউর রহমান (নৌকা), বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো: আমিনুল ইসলাম (ধানের শীষ), ইসলামী আন্দোন বাংলাদেশের মু. ইব্রাহিম খলিল (হাতপাখা)।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো: আব্দুল ওদুদ এমপি (নৌকা), বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মো: হারুনুর রশীদ (ধানের শীষ), ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল ইসলাম বুলবুল (আপেল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আব্দুল কাদের (হাতপাখা), বিএনএফের প্রার্থী কামরুজ্জামান খান (টেলিভিশন), জাকের পার্টি প্রার্থী মো: বাবলু হোসেন (গোলাপ ফুল)।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনামসজিদ স্থলবন্দর। রয়েছে ৫০০ বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ছোট সোনাসমজিদসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা। আলোচিত কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন এ আসনটিতে। একসময় বারবার বিএনপির করতলগত ছিল এ আসনটি। বিএনপি নেতা অধ্যাপক সাজাহান মিয়া এ আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এখানে জয়ী হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক সেনাকর্মকর্তা এনামুল হক। এরপর বিএনপিহীন ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রব্বানী নির্বাচিত হন। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হওয়ায় অধ্যাপক সাজাহান মিয়া রয়েছেন এখানে কিছুটা সুবিধাজনক পর্যায়ে। চারবারের সাবেক এমপি তিনি। যদিও দলীয় কোন্দল এবং বিগত দিনের নানা অভিযোগ তাকে জর্জরিত করছে। তথাপি এ সঙ্কট কেটে যাবে বলে তার ধারণা। তা ছাড়া এ আসনে জামায়াতের রয়েছে বিশাল ভোটব্যাংক। বিএনপি এখানে জোট প্রার্থী হওয়ায় এটিকে প্লাস পয়েন্ট মনে করা হচ্ছে। শরিক দল হিসেবে জামায়াতের সমর্থন লাভ করতে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। তাই সুফলপ্রত্যাশী এখানকার বিএনপি সমর্থকেরা। এ দিকে আওয়ামী লীগে নতুন মুখ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: শিমুল এ আসনের প্রার্থী। তিনি সাবেক বিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা ডা: মঈনউদ্দিন ওরফে মন্টু ডাক্তারের ছেলে। বর্তমান এমপি গোলাম রব্বানি এবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। তার পরিবর্তে মনোনয়ন পেয়েছেন ডা: সামিল উদ্দিন শিমুল। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ডাক্তারি পেশার পথ ধরে এলাকায় অনেক আগে থেকেই তিনি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বর্তমান এমপি গোলাম রব্বানিকে প্রার্থিতায় প্রতিযোগিতা করে শিকে ছিড়েছেন তিনি। একইভাবে ইতঃপূর্বের আরেক সংসদ সদস্য হেভি ওয়েট প্রার্থী সাবেক সেনাকর্মকর্তা এনামুল হকও আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় আরেক নেতা ইঞ্জিনিয়ার মাহতাব উদ্দিন দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচেষ্টা চালিয়েও মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। স্বাচিপ নেতা ডা: শিমুলের সাথে আরেক স্থানীয় নেতা আপন মামা মির্জা শাহাদাত হোসেন খুররমের দীর্ঘদিনের বিরোধটি এখানে সবাই জানে। সুতরাং গৃহদাহের অশনি সঙ্কেত রয়েছে এখানে। সব কিছু পাশ কাটিয়ে তার উৎরে যাওয়ার লড়াইটা বেশ কঠিন হবে বলে স্থানীয় মহল মনে করছে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত যে, নৌকা আর ধানের শীষেই হবে লড়াই। শেষ হাসি কে হাসবেন তা শুধু সময় বলে দেবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনটি মূলত নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত। ২০০৮ সালের আগে পর্যন্ত মূলত আসনটি ছিল বিএনপির দখলে। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের চারটি সংসদ নির্বাচনে এ আসন ছিল বিএনপির দখলে। মরহুম সৈয়দ মঞ্জুর রহমান ধানের শীষ নিয়ে চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে ২০০৮ সালে। সেবার বিএনপি প্রার্থী আমিনুল ইসলামকে পরাজিত করে বিজয়ী হন নৌকার প্রার্থী জিয়াউর রহমান। মাঝখানে ১০ম সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হয়ে বিজয় লাভ করেন গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস। এবার তিনি প্রার্থিতা বঞ্চিত হয়েছেন। পুনরায় প্রার্থিতায় ফিরে এসেছেন দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত নেতা জিয়াউর রহমান। গোলম মোস্তফাকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমানকে প্রার্থিতা প্রদান করা হলে গোমস্তাপুর ও নাচোলে বিক্ষোভ সমাবেশ করে মোস্তফার অনুসারীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধীয় অবস্থার মধ্যেই মনোনয়ন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। জানা যায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা চালিয়েছেন জিয়াউর রহমান। সবমিলিয়ে তার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অপর দিকে বিপরীত চিত্র বিএনপি শিবিরে। এখানে ঘরের আগুনে পুড়ছে বিএনপি। আসনটিতে বিএনপির বিভক্তি ওপেন সিক্রেট। আমিনুলের প্রার্থিতায় যারা নাখোশ হয়েছেন এমন ঘরানার নেতারা রয়েছেন নির্বাচন বিষয়ে অনেকটাই নিষ্ক্রীয়। ফলে মাঠপর্যায়ে অনেকটাই কোণঠাসা বিএনপি প্রার্থী। এ অঞ্চলের অন্যতম নেতারা বিএনপি প্রার্থী আমিনুল ইসলামের রূঢ় আচরণের সমালোচনা করেন সাংবাদিকদের সামনে। অভিমান ও বিরোধ মেটাতে না পারলে বিএনপির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি কঠিন হবে বলে অনেকের ধারণা। তবে শেষ পর্যন্ত যে এখানে দ্বিমুখী লড়াই অনুষ্ঠিত হবে এ কথা নিশ্চিত।
পরিশেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হালচিত্র। মূলত এটি সদর উপজেলার আসন। এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থিতা লাভ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ। তিনি বিগত পরপর দুইবারের এমপি। এবার তার প্রার্থিতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকার পরও তিনি শিকে ছিঁড়েছেন। ফলে কেন্দ্রে তার অবস্থান সুদৃঢ় বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। টানা ১০ বছর এমপি থাকার সুবাদে তিনি ব্যাপক কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। এ কারণে তিনি আলোচিত ও পাশাপাশি সমালোচিত। এ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকায় অনেকেই মনে করছেন এটিই ওদুদের ট্রাম কার্ড। তাই নির্বাচনে তার উৎরে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখছেন জেলার নাগরিক মহল। আসনটিতে বিএনপির প্রার্থী হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে বিজয় লাভ করেছিলেন। তাই আসনটিকে বিএনপির দুর্গ হিসেবে অনেকে আখ্যায়িত করেন। একসময় রাজনৈতিকভাবে নিজ দলের মধ্যে বিরোধের জেরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। এবার স্থানীয় বিএনপিতে দীর্ঘ দিনের বিরোধ ভেঙে নেতাকর্মীরা একযোগেই কাজ শুরু করেছেন বলে জানা যায়। এখন দেখার বিষয় এই সমঝোতা তাকে বিজয় কিনারায় পৌঁছাতে পারে কি না! নৌকার প্রার্থী আব্দুল ওদুদ হলেন তার আপন চাচাতো ভাই। দুই ভাইয়ের মধ্যে কী লড়াই হয় তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন এলাকাবাসী। অন্য দিকে আসনটি বরাবরই জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিহ্নত। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে পরপর দুাইবার জামায়াত প্রার্থী লতিফুর রহমান এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০১ সালে বিজয়ী বিএনপির প্রার্থী হারুনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে তিনি জামায়াত প্রার্থী হিসেবে পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। বিগত উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের দেয়া পুরো প্যানেল সদর উপজেলায় জয়লাভ করেছে। বিগত পৌরসভা নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী নজরুল ইসলাম জয়লাভ করে বর্তমানে পৌরমেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং জামায়াত প্রভাবিত আসন বলার যৌক্তিকতা যথেষ্টই রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। এবারো এখানে জামায়াত প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল আপেল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সব স্থানে জোট হলেও কেন এখানে বিএনপির সাথে জোট হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় জামায়াত নেতা সাবেক এমপি অধ্যাপক লতিফুর রহমান জানান, কেন্দ্রীয় সংগঠনের সিদ্ধান্তক্রমে এখানে প্রার্থিতা দেয়া হয়েছে। এখানে জামায়াতের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আসনটির জন্য তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জোট বিএনপি-জামায়াত উভয়কেই ভোট করার অনুমতি প্রদান করেছে। সে অর্থে বুলবুল জোটেরও প্রার্থী। এ দিকে যদিও জামায়াতের প্রার্থিতা দেয়ার বিষয়টি সর্বমহলে সমর্থন লাভ করেনি, তথাপি বুলবুলকে অনেকেই দেখছেন ফেভারিট হিসেবে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম জানান, বিগত দিনের সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ। সে সময় বিএনপি প্রার্থী হারুনকে মাঠে তেমন দেখা যায়নি। অথচ এ কারণে জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে প্রায় ৪০০ মামলা রুজু হয়েছে। তাদের নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এ থেকে বুলবুলের প্রতি গণসমর্থন সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকে আবার মাইনাস টু ফর্মুলার কথা বলেছেন। তাদের ভাষ্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থী সম্পর্কে আপন চাচাতো ভাই। তাদের হাতেই এখানকার মানুষের ভাগ্য বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষ চায় নতুন কিছু পেতে। সে কারণেও বুলবুলের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যার ফলে বুলবুলই হয়ে উঠতে পারেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

 


আরো সংবাদ



premium cement