নয়াপল্টন শান্ত ও উৎসবমুখর সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা গতকাল চতুর্থ দিনেও ঢাকঢোল পিটিয়ে মিছিলসহ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিড় জমান। তাদের পদচারণায় নয়াপল্টনজুড়ে উৎসবের আমেজ দেখা যায়। নয়াপল্টন এলাকা ছিল শান্ত। নেতাকর্মীরা নিজেরাই যানবাহন চলাচলে সহায়তা করেন। তবে গত বুধবার পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনায় কিছুটা অস্বস্তি ও ভীতিও পরিলক্ষিত হয় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। অন্য দিকে গতকাল পুলিশকে দেখা গেছে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিতে। গতকাল চতুর্থ দিনেও সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিএনপির মনোনয়নপত্র বিক্রি হয় ৪০২টি, আর জমা পড়ে ৮৫৮টি। চার দিনে চার হাজার ১১২টি ফরম বিক্রি করেছে বিএনপি। গত ১২ নভেম্বর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করে বিএনপি, যা শেষ হবে আজ শুক্রবার। প্রথম দিন বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দী খালেদা জিয়ার জন্য ফেনী-১, বগুড়া-৬ এবং ৭ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের মাধ্যমে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির মনোনয়ন ফরমের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে। তবে জমা দেয়ার সময় জামানত হিসেবে দিতে হচ্ছে আরো ২৫ হাজার টাকা।
সরেজমিন দেখা যায়, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে থাকেন দলটির নেতাকর্মীরা। শুরুর দিকে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম থাকলেও ১২টার পর থেকে রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে থাকেন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারী নেতা ও তাদের সমর্থকেরা। মনোনয়ন সংগ্রহকারীদের মিছিলের পাশাপাশি বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল, যুবদলের নেতাকর্মীদের দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত মিছিল করতে দেখা গেছে। মিছিল থেকে মনোনয়ন সংগ্রহকারী নেতার পে স্লোগান দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের স্লোগান দেন দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা। এদিকে অন্য সময় পুলিশ সদস্যরা বিএনপির কার্যালয়ের পাশে হোটেল মিডওয়ের সামনে অবস্থান করলেও গতকাল তাদের সেখান থেকে সরে এসে নাইটিংগেল মোড়ে স্কাউট মার্কেটের সামনে, বিজয়নগর এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করতে দেখা গেছে। উল্লেখ্য, গত বুধবার মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।
মনোনয়নপত্র সংগ্রহ : গতকাল যারা বিএনপির মনোনয়নপত্র কিনেছেন তাদের অন্যতম হলেন- নোয়াখালী-৩ বরকতুল্লাহ বুলু ও তার স্ত্রী শামীমা বরকত লাকী, খুলনা-৩ ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুল, রাজবাড়ী-২ অ্যাডভোকেট আসলাম মিয়া, পঞ্চগড়-১ ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, পঞ্চগড়-২ ফরহাদ হোসেন আজাদ, ঢাকা-১৮ বাহাউদ্দিন সাদী, চাঁদপুর-৫ জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু, কিশোরগঞ্জ-১ মো: মোফাজ্জল হুসাইন নিটোল, নোয়াখালী-৬ আব্দুল কাদের হালিমী, ময়মনসিংহ-২ মোজাম্মেলর হক মৃধা, কুমিল্লা-২ শরিফুল ইসলাম, ফেনী-১ ও ২ আসন থেকে রফিকুল আলম মঞ্জু, কুমিল্লা-৪ অ্যাডভোকেট মো: ফারুক হোসেন প্রমুখ।
জমা দান : গতকাল যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাদের অন্যতম হলো- ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, কুমিল্লা-১১ নিয়াজ মাখদুম মাসুম বিল্লাহ, মাদারীপুর-১ (শিবচর) ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান, ময়মনসিংহ-৯ মামুন বিন আবদুল মান্নান, মাদারীপুর-৩ খন্দকার মাশুকুর রহমান মাশুক, মাদারীপুর-২ শারমিন ইসলাম ডেইজি, নোয়াখালী-২ রফিকুল আলম মজনু, টাঙ্গাইল-৩ শিল্পপতি মো: মাইনুল ইসলাম, বরিশাল-৬ খাজা সলিমুল্লাহ টিপু, পিরোজপুর-১ আনোয়ারুল ইসলাম পলাশ, ঢাকা-৫ মশিউর রহমান মিশু, শরীয়তপুর-৩ মিয়া নূর উদ্দীন অপু, নরসিংদী-৪ আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, ঝিনাইদহ-৪ সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, বরিশাল-১ আকন কুদ্দুসুর রহমান, পাবনা-২ সেলিম রেজা হাবিব, পিরোজপুর-১, ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন, সিরাজগঞ্জ-৫ আমিরুল ইসলাম খান আলিম, টাঙ্গাইল-৭ আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকীর পক্ষে স্ত্রী, গাজীপুর-২ আহমেদ সাইমুম, ঢাকা-১৩ খন্দকার জিল্লুর রহমান, মৌলভীবাজার-৪ হাজী মুজিবুর রহমান, নীলফামারী-৪ বেবী নাজনীন, ঢাকা-১ খন্দকার আবু আশফাক, চট্টগ্রাম-২ কাদের গণি চৌধুরী প্রমুখ।
দিনাজপুর-১ আসনের সুমনের গণসংযোগ : দিনাজপুর-১ (কাহারোল-বীরগঞ্জ) আসনে ধানের শীষ মার্কায় একাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান বিশিষ্ট শিল্পপতি ও দিনাজপুর জেলা যুবদলের সহসভাপতি মো: মেহেদী হাসান সুমন। তিনি বিএনপির মনোনয়ন লাভের আশায় দলের মনোনয়নপত্র কিনে জমাও দিয়েছেন। ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এলাকায় গণসংযোগ চালান তিনি। তার মতো তরুণ একজন নেতা পেয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ব্যাপক খুশি। পোস্টার-ব্যানার লাগানোর মাধ্যমে ধানের শীষের ব্যাপক গণসংযোগ তার নির্বাচনী এলাকায় সাড়া ফেলেছে। দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী সুমন বলেন, এলাকাবাসীর প্রত্যাশা পূরণে তিনি দিনাজপুর-১ আসনে বিএনপির হাল ধরতে চান। দল তার কার্যক্রম মূল্যায়ন করলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনিই বিএনপির মনোনয়ন পাবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
চার দিনে ৪১১২টি মনোনয়নপত্র বিক্রি : গতকাল চতুর্থ দিন পর্যন্ত দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছে চার হাজার ১১২টি ফরম বিক্রি করেছে বিএনপি। প্রথম দিন ১৩২৬টি, দ্বিতীয় দিন ১৮৯৬টি, তৃতীয় দিন ৪৮৮টি এবং গতকাল চতুর্থ দিন বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৪০২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আজকেও সারা দিন ফরম বিক্রি করা ও জমা দান চলছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা জমা দিচ্ছেন এবং আমাদের সাথে শুভেচ্ছাবিনিময় করে তারা নিজ নিজ এলাকায় চলে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত আজকে (গতকাল) জমা পড়েছে ৮৫৮টি মনোনয়ন ফরম এবং বিক্রি হয়েছে ৪০২টি ফরম। গত দুই দিনে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছে এক হাজার ২০৯ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী।
বুধবারের সহিংসতার ঘটনার পর পুলিশ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে তিনটি মামলা দায়ের করেছে তার নিন্দা জানিয়ে রিজভী বলেন, কিছু দিন আগে যে পুলিশ বাহিনী গায়েবি ও উদ্ভট মামলা দিতে পারেন মৃত মানুষের নামে, হাসপাতালে শায়িত ব্যক্তির নামে, বিদেশে হজ পালনকারী মানুষের নামে তাদের মানুষ বিশ্বাস করে না। এই যে মামলা তা হাস্যকর। এই মামলার মাধ্যমে পুরো জাতির কাছে পুলিশ প্রশাসন তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। পুলিশের সহিংস আক্রমণ প্রকাশ পেয়েছে। এখন তারা উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে। এটি চাপাতে গিয়ে তারা নেতৃবৃন্দের নামে মামলা দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুকে দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তার পুত্র বলেছেন ‘বিএনপির সব নেতাকর্মীকে জেলে ভরা উচিত’। এ হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মানসিকতা। কারণ প্রতিযোগিতা থাকলে আওয়ামী লীগ থাকবে না, জনগণ থাকলে তারা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। সেজন্য তারা বিরোধীদল, প্রতিযোগিতা, নির্বাচন সব কিছুকেই তালাক দিয়েছে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রীর তনয়ের মুখ দিয়ে এই ধরনের কথা বেরুতে পারে যে সবাইকে জেলে ঢুকানো উচিত? ওনারা আমাদের সবাইকে জেলে ঢুকাবেন আর দেশের জনগণ একেবারে নির্বাক তাকিয়ে থাকবে। উনারা মালিক মোক্তার সেজে বসবেন, কারোর কিছুই করার থাকবে না- এটি ভাবার কারণ নেই।