২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অদৃশ্য পাঠ্যবই রয়েছে পঞ্চম শ্রেণীতে?

প্রাথমিকের পাঠ্যবই ( ৫)
-

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবি কর্তৃক পঞ্চম শ্রেণীতে পাঠ্যবই ছয়টি। তবে অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন আরো দুইটি পাঠ্যবই রয়েছে এবং তা অদৃশ্য। এ দু’টি হলো বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই। সরকার কর্তৃক ব্যাকরণ বই পাঠ্য করা হয়নি। কিন্তু পরীক্ষায় ব্যাকরণ বিষয়ে এমন সব প্রশ্ন আসে যাতে সব শিক্ষার্থীকে বাজার থেকে ব্যাকরণ বই কিনে ব্যাকরণ শিখতে হয়। যেনতেন প্রকারে শিখলেও চলে না। ব্যাকরণ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষেই ইংরেজিতে ভালো করা সম্ভব নয়।
কয়েকজন অভিভাবক জানান, সরকার নির্ধারিত ছয়টি পাঠ্যবইয়ের সাথে শুধু যে দুইটি গ্রামার বই অতিরিক্ত পড়তে হচ্ছে তা নয়। বরং প্রতি বিষয়ে একাধিক গাইড বই কিনতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। স্কুল থেকেই এসব গাইডের নাম বলে দেয়া হয়। এ ছাড়া কিনতে হচ্ছে ইংরেজি ও গণিতের টেস্ট পেপারস। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরও টেস্ট পেপারস কিনতে হচ্ছে বলে আফসোস প্রকাশ করলেন অনেক অভিভাবক। সব মিলিয়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাথায় যেন বইয়ের পাহাড়। কমপক্ষে ১৬ থেকে ২০টি ভারী ভারী বই তাদের পড়তে হচ্ছে এবং এজন্য তারা সময় পাচ্ছে মাত্র ৯ থেকে ১০ মাস। সব মিলিয়ে পড়ার চাপে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের দিশেহারা অবস্থা।
বনশ্রীর নামকরা একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর অভিভাবক সারা স্নেহা এ প্রতিবেদকে জানান, আমি আমার মেয়েকে পড়াই। পঞ্চম শ্রেণীর একটি শিশুর জন্য পাঠ্যবইয়ের জটিল সব বিষয় এবং তার ব্যাপকতা দেখে আমি শুধু বিস্মিত নই, খুবই মর্মাহতও। এর নাম পড়ালেখা হতে পারে না। এটা রীতিমতো নির্যাতন শিশুদের প্রতি। ইংরেজি বিষয়ে তিনি বলেন, ইংরেজি বই এবং তার প্রশ্নপত্র এমনভাবে সাজানো যে, পঞ্চম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি বিষয়ে মাতৃভাষার মতো দক্ষ হতে হবে। আমরা তাদের ইংরেজি শেখাতে আগ্রহী কিন্তু বাস্তব কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ প্রধানত দুইটি। প্রথমত সময় নেই। দ্বিতীয়ত ইংরেজির মতো অন্য সব বিষয়ে বেশি পড়ার চাপ। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যে ইংরেজি পড়তে হয় এবং এজন্য যে সময় তারা পায় তাতে তাদের পক্ষে ইংরেজিতে অতটা দক্ষ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়, যতটা দক্ষতা পরীক্ষায় যাচাই করা হচ্ছে। ইংরেজি ছাড়াও প্রতিটি বই খুবই ভারী এবং রয়েছে কঠিন সব বিষয়। প্রত্যেক বিষয়ে যদি এত বিস্তারিত শেখানোর ব্যবস্থা করা হয় এত ছোট শিশুদের তাহলে তারা ইংরেজিতে দক্ষ হওয়ার জন্য যে সময় দারকার তা তারা পাবে কোথায়? ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো বই যদি না থাকত তাহলে ইংরেজি বই এবং প্রশ্নপত্রের যে ব্যাপকতা তা মেনে নেয়া যেত। তারা ভালো করে ইংরেজি শিখতে পারত। কিন্তু তা তো সম্ভব হচ্ছে না।
সারা জানান, পঞ্চম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে পার্টস অব স্পিস, টেন্স, সেন্টেন্স পূর্ণরূপে জানতে হবে, যা আমরা শিখেছি ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সময়ে।
তিনি বলেন, টেন্স তিন প্রকার এতটুকু শিখলেই চলবে না। প্রতিটির যে আবার চারটি করে রূপ রয়েছে সেটাও শিখতে হচ্ছে। এভাবে পার্টস অব স্পিচের মূল ভাগগুলোসহ প্রত্যেকটি সম্পর্কে আবার বিস্তারিত শেখাতে হচ্ছে। একইভাবে সেনটেন্সেরও যত প্রকারভেদ আছে তা শেখাতে হচ্ছে। কারণ পরীক্ষায় এ বিষয়ে প্রয়োগমূলক প্রশ্ন আসে।
যেমন, পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে সাধারণ বাক্যকে প্রশ্নবোধক বাক্যে পরিণত কর। শুধু এতটুকু থাকলেও চলত। কিন্তু বাক্যের নির্দিষ্ট শব্দের নিচে দাগ দিয়ে বলা হয় এমনভাবে প্রশ্নবোধক বাক্যটি করতে হবে যাতে দাগ দেয়া বিষয়টি প্রশ্নের উত্তরে আসে।
২০১৭ সালের পরীক্ষায় আসা একটি বাক্য এরকম Ritu gets up early in the morning. এ বাক্যটির প্রশ্নবোধক রূপ হবে When does Ritu get up?সারা বলেন, এখন চিন্তা করে দেখুন এটি করতে হলে পঞ্চম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি ভাষা ও ব্যাকরণ সম্পর্কে কেমন দক্ষ হতে হবে। সারা ইংলিশ ফর টুডে বই থেকে ১২ পৃষ্ঠা দেখিয়ে বলেন, এখানে যিরষব শব্দ ব্যবহার করে পাস্ট কনটিনিউয়াস বাক্যের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। Yesterday at 8 o'clock, my friends and I were sitting in our classroom while Ms. Kona was teaching.
এরপর এ ধরনের আরো বাক্য লিখতে বলা হয়েছে। সারা প্রশ্ন করে জানান, এত জটিল পর্যায়ে শিশুদের নিয়ে যাওয়ার কি আদৌ প্রয়োজন ছিল?
সারা বলেন, এরকম আরো অনেক উদাহরণ দিলে এটা পরিষ্কার হবে যে, ব্যাকরণ ও ইংরেজি ভাষায় পুরো দক্ষ না হলে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ে ভালো করা সম্ভব নয়। আনসিন কম্পোজিশন দেয়া থাকে প্রশ্নে। সেখানে এমনসব প্রশ্ন থাকে এবং প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে লিখতে বলা হয় যাতে আপনাকে ব্যাকরণ ভালোভাবে জানতেই হবে।
সারা স্নেহার সাথে আলাপকালে উপস্থিত ছিলেন তার স্বামী জহিরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসকৃত জহিরুল ইসলাম জানান, আমার মেয়ের ইংরেজি বইটি আমিও দেখেছি। আমি ইংরেজি ও বাংলা ব্যাকরণে ভালো ছিলাম স্কুলজীবনে। কখনো প্রাইভেট পড়ে গ্রামার শিখিনি। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামার বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে গ্রামার শিখেছি। কিন্তু জীবনে কখনো গ্রামার বইয়ে Occupation nouns, Stressed syllables-এর নাম দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ে এসব দেখছি।
সারা স্নেহা জানান, বাংলায়ও একই অবস্থা। পরীক্ষায় ক্রিয়াপদের চলিত রূপ, ভবিষ্যৎ রূপ, পদ নির্ণয় করতে বলা হয়।
প্রাথমিকের পাঠ্যবই নিয়ে যত অভিভাবকের সাথে আলাপ হয়েছে তাতে প্রায় সব অভিভাবকের একই অভিযোগÑ বইতে নেই এমন বিষয়ে প্রশ্ন আসবে কেন? শিশুরা এটা পাবে কোথায়? প্রশ্নই যদি করা হবে তাহলে বইতে তা রাখা হলো না কেন? অথবা আলাদা করে ব্যাকরণ বই পাঠ্য করলেই হতো।
সারা জানান, পঞ্চম শ্রেণীর যে বই আর যে পড়া তাতে শুধু শিক্ষার্থী নয়, মা-বাবা সবাইকে মিলে সারা বছর সন্তানের পেছনে দৌঁড়াতে হচ্ছে। এ লেখাপড়া বদলানো দরকার। তিনি বলেন, দেশের সবচেয়ে মেধাবী একজন শিক্ষার্থীকে সামনে রেখে মনে হয় বই রচনা করা হয়েছে। গ্রামের সাধারণ শিক্ষার্থী, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানদের কথা চিন্তা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। আমারা দিন-রাত সন্তানের পেছনে সময় দিয়েও ভালো করে বই আয়ত্ত করাতে পারছি না। এত পড়া যে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। সন্তানদের কথা কী বলব, আমরাই হাঁপিয়ে উঠছি। আমার এক বান্ধবী তার পঞ্চম শ্রেণীর সন্তানের জন্য তিনটি কোচিং করাচ্ছেন। কোচিংয়ে যেতে-আসতেই তার রিকশা ভাড়া লাগে মাসে পাঁচ হাজার টাকা। সারা দিন তার কেটে যাচ্ছে এক কোচিং থেকে আরেক কোচিংয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে। এ অবস্থা রাজধানীর প্রায় সব মায়ের। এ অবস্থায় গ্রামের একজন গরিব ঘরের শিক্ষার্থীর কথা ভেবে দেখুনÑ তাদের অবস্থা কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার পড়ানো বিষয়ে বলেন, এ বয়সের শিক্ষার্থীদের গ্রামার শেখানো কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়। গ্রামারের কারণে তাদের বাক্যের ভুল ধরাও কাম্য নয়।


আরো সংবাদ



premium cement