২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ছন্দপতন

১৭ মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করতে পারেনি; জুলাই-সেপ্টেম্বর এডিপির বাস্তবায়ন তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্নে; বাস্তবায়ন ক্ষমতা বাড়েনি এবং জবাবদিহিতা নেই-অর্থনীতিবিদ
-

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ছন্দপতন ঘটেছে। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের ওই মেয়াদের শেষ দিকে এবং বতর্মান মেয়াদের সূচনায় প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ছন্দ ছিল, সেটি তারা ধরে রাখতে পারছে না। দৃশ্যমান হাতেগোনা কিছু প্রকল্প ছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন ঢিমেতালে এগোচ্ছে।
২০১৪ সালে যেখানে একই সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হার ছিল ১০ শতাংশ, সেটি এখন নেমে এসেছে এক অঙ্কের ঘরে। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও চলতি (২০১৮-১৯) অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এডিপির বাস্তবায়ন গত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বনি¤েœ। আর গত অর্থবছরের চেয়েও অনেক কম। তিন মাসে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র সোয়া ৮ শতাংশ। আগের বছর তা ছিল প্রায় সোয়া ১০ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ থাকলেও ১৭টি মন্ত্রণালয় কোনো অর্থই ব্যয় করতে পারেনি বলে আইএমইডির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এডিপির আকার অনুযায়ী বাস্তবায়ন ক্ষমতা বাড়েনি। প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো জবাবদিহিতা নেই, যে কারণে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও বাস্তবায়ন হার নি¤œমুখী। এটি কাম্য নয়।
বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পর্যালোচনা সভার তথ্যানুযায়ী, তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি আবারো তৃতীয় দফায় সংশোধন করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ২০০৩ সালের এ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। অর্থের পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। পায়রা (লেবুখালি) সেতু নির্মাণকাজও ধীর গতিতে এগোচ্ছে। ২০১২ সালে নেয়া এ প্রকল্পটি ছয় বছর পর এসে আবার সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ কাজের অগ্রগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
২০১২ সালে নেয়া গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প, সাসেক জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা রোড প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগ সড়ক প্রকল্প, সাসেক সংযোগ রোড-২, আশুগঞ্জ নদীবন্দর সরাইল, আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ক প্রকল্প, ঢাকা চট্টগ্রাম এক্সপ্রেস ওয়ের বিস্তারিত স্ট্যাডি প্রকল্প, ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট ক্যাপাসিটি উন্নয়ন প্রকল্প, ২০১৬ সালে নেয়া বিআরটিসির জন্য বাস সংগ্রহ, ঢাকা মাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, ঢাকা সার্কুলার রুট প্রকল্পসহ মোট ২৫টি প্রকল্পের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট নয় খোদ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সিলেট শহর বাইপাস-গ্যারিসন লিংক টু শাহ পরান সেতুঘাট সড়ক চার লেন করার প্রকল্পটি চলতি বছর ডিসেম্বরে শেষ করার কথা। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক জানান, রাস্তার মাটির ধরন যথাযথ না হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। মেয়াদ আরো ছয় মাস বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাস্তবায়ন হার ১৩ শতাংশ ছিল। পরের বছর ২০১৩-১ তে ১০ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৯ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৭ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৮.৭৫ শতাংশ, ২০১৭-১৮ তে ছিল ১০.২১ শতাংশ। আর এবার এ হার আরো কমে ৮.২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি আলোচিত সময়ে সবচেয়ে বেশি কমেছে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের পরিমাণ। কমেছে জিওবি অর্থ ব্যবহারও। গত অর্থবছর একই সময়ে যেখানে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের হার ছিল ১২ দশমিক ৮৬ শতাংশ, সেটা বর্তমান বছরে হয়েছে ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এখানে ৪ দশমিক ২০ শতাংশ ব্যবহার কমেছে। অন্য দিকে সরকারি অর্থও ব্যবহার করতে পারেনি বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্ম কমিশন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়।
চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ২৪ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে বরাদ্দের ৫ শতাংশও ব্যয় করতে পারেনি। এর মধ্যে এডিপির বড় বড় প্রকল্প রয়েছে এমন অনেক মন্ত্রণালয় রয়েছে। বিশেষত রেলপথ মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়ে এডিপির অনেক বড় বড় প্রকল্প রয়েছে। গত তিন মাসে এডিপিতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে সবচেয়ে বেশি ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বিভাগটি এডিপি বরাদ্দের ২৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ ব্যয় করেছে।
অন্য দিকে ৫৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ১৭টি মন্ত্রণালয়ই বিদেশী সাহায্য বরাদ্দ পেয়েও তা ব্যবহার করতে পারেনি। এদের মধ্যে সেতু বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল এক হাজার ৬৫৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জন্য ১২৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য এক হাজার কোটি টাকা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জন্য এক হাজার ৪০৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু তারা এ অর্থের একটি টাকাও গত তিন মাসে ব্যয় করতে পারেনি।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের অর্থবছর শুরু হয় বর্ষা মওসুমে; যে কারণে বছরের শুরুতে এডিপি বাস্তবায়নে বিশেষ গতি থাকে না। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের বিপরীতে মঞ্জুরি পেতেও সময় লাগে। আবার বরাদ্দ পাওয়ার পর কাজ শেষ হলেই তা ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়। সে কারণেই ব্যয় কম। অনেক কাজের বিল পরিশোধ না হলে বাস্তবায়ন দেখানো যায় না।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অর্থবছরের সূচনায় কাজ শুরু করা যায় না। এবারো একই কারণে প্রথম তিন মাস বাইরের কাজ করা যায়নি। অবকাঠামোর কাজগুলো বৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত হয়। আশা করছি আগামীতে এই গতি বাড়বে।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির পর্যালোচনায় জানিয়েছে, চার ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এ দেশের অর্থনীতি। এগুলো হলো আমদানি চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, মেগা প্রকল্পগুলোতে চাহিদামতো অর্থায়ন করতে না পারা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও প্রতিকূল আবহাওয়া। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে অবশ্যই এডিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বাড়াতে হবে।
অন্য দিকে বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) থাকা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন হার সন্তোষজনক নয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে তাগাদা দিয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও এডিবির মধ্যে যৌথ পর্যালোচনা সভায় এ তাগিদ দেন দাতা সংস্থা এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বিশ্লেষণ হলো, আমাদের এডিপির আকার বাড়ছে। সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন ক্ষমতা বাড়ছে না। এক লাখ কোটি টাকার এডিপি যে বাস্তবায়ন ক্ষমতা দিয়ে করা হতো এখন আকার বাড়লেও দক্ষতায় সে রকম কোনো উন্নয়ন হয়নি। পুরনো ট্র্যাডিশন রয়েই গেছে। তিনি বলেন, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহার না করাই একটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে। আর এখানে কোনো ধরনের জবাবদিহিতা নেই।
তার মতে, প্রকল্প বাড়ছে প্রতি বছর; যে কারণে প্রকল্পের যথাযথ তদারকি হচ্ছে না। প্রকল্প ঠিকমতো শুরু হচ্ছে কি না, বাস্তবায়নের গতি এসব কিছুই দেখভাল করা হচ্ছে না; যে কারণে প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার পর তার সময় ও ব্যয় বছর গেলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে হারে প্রকল্প যুক্ত করা হয়, সে হারে বাস্তবায়ন ক্ষমতা বাড়েনি। তিনি বলেন, এখনো সরকারের মেয়াদ শেষ হয়নি। তা ছাড়া দেশের রাজনৈতিক ও সার্বিক পরিস্থিতি ভালো আছে। ফলে সোয়া ৮ শতাংশ তিন মাসের অগ্রগতি মোটেই প্রত্যাশিত নয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement