১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরমে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ৩ জন

পটুয়াখালী-৩ আসন
-

পটুয়াখালী-৩ আসনটি গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলা নিয়ে গঠিত। আগুন মুখা ও বুড়া গৌরঙ্গ নদীর দুই তীরে উপজেলা দু’টি অবস্থিত। গলাচিপা উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এবং দশমিনার ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে মোট ভোটার ২ লাখ ৩০ হাজার ৭০৩ জন। এর মধ্যে গলাচিপা উপজেলা ও পৌরসভায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৯১৩ জন এবং দশমিনায় ৯৩ হাজার ৬৫৪ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিকটবর্তী হওয়ায় এ আসনেও ভোটের হাওয়া জোরেশোরে বইতে শুরু করেছে। আসনে দীর্ঘদিন থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে আসছে। ফলে আসন্ন নির্বাচনেও দেশের প্রধান দুই দল থেকে কারা মনোনয়ন পাচ্ছেন তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছে নানা ধরনের আলোচনা। দুই দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে এ আসনে আ’লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। দলটির ৭-৮ জন নেতা মনোনয়ন লাভের জন্য চেষ্টা করছেন। অন্য দিকে বিএনপির তিনজন নেতা দলের মনোনয়ন লাভে সচেষ্ট রয়েছেন।
এ আসনে বেশির ভাগ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এ কারণে আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বিএনপি কর্মীদের দাবি আগামী নির্বাচনে কিন ইমেজের নতুন মুখ প্রার্থী করলে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ মনে করছে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল না করলে ইতিহাস তাদের অনুকূলে থাকবে।
এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ৯৬ সালে দল ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করে দল থেকে ছিটকে পড়েন। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। মনোনয়ন দেয়া হয় গোলাম মাওলা রনিকে। তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। কিন্তু তার সমর্থক একটি গ্রুপের হাতে গলাচিপায় কয়েকজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ায় এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন শিল্পপতির সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তার কপাল পোড়ে। তিনি আ’লীগ হাইকমান্ডের বিরাগভাজন হন। ফলে আবার ভাগ্য খুলে যায় আ খ ম জাহাঙ্গীরের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা বা ভোটারবিহীন নির্বাচনে তিনি এমপি হন।
স্থানীয় আ’লীগ কর্মীদের অভিযোগ, আ খ ম জাহাঙ্গীর এবার এমপি হওয়ার পর নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি আর টিআর কাবিখা, ৪০ দিনের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এসব নিয়ে নিজ দলে তীব্র সমালোচিত হন তিনি। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি নিয়ে গলাচিপা শহরে স্থানীয় আ’লীগে জাহাঙ্গীরের প্রতিপক্ষ গ্রুপ পাল্টা কর্মসূচি পালন করে। এ নিয়ে দু’গ্রুপে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
এ ঘটনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়ে স্থানীয় আ’লীগের দ্বন্দ্ব এখন তুঙ্গে। খ ম জাহাঙ্গীরের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন গলাচিপা পৌরসভার মেয়র আহসানুল হক তুহিন, দশমিনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন শওকত, গলাচিপার উপজেলা আ’লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মানিক মিয়া, গলাচিপা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান, জেলা আ’লীগের সহসভাপতি কাশিনাথ ধর, এস এম শাহজাদা, কামরান সাইদ প্রিন্স মহব্বত ও ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তারা সবাই দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি। এসব নেতা তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে একসময় পরিচিত থাকলেও বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। এসবের মধ্যেও খ ম জাহাঙ্গীর একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
খ ম জাহাঙ্গীর ছাড়াও এ আসনে আ’লীগের মনোনয়ন লাভে গণসংযোগ করছেন দশমিনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন শওকত। ব্যক্তি জনপ্রিয়তা, অপর দিকে দলের ইমেজ কাজে লাগিয়ে সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হতে চান তিনি। এ ছাড়াও দলীয় মনোনয়ন লাভের জন্য কয়েক বছর ধরে এলাকায় গণসংযোগ করছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক কামরান সাইদ প্রিন্স মহব্বত। দুস্থ মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে দান-অনুদান দেয়া ছাড়াও সামাজিক নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। ইতোমধ্যে দানশীল ব্যক্তি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন মহব্বত। ভোটারদের নজর কাড়তে নানা কৌশলে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার ভাগ্নে এস এম শাহজাদাও নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করছেন।
আ’লীগের মনোনয়ন লাভে সচেষ্ট রয়েছেন সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনিও। তিনি এমপি থাকার সময় গলাচিপা-দশমিনার বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। দুই উপজেলার আ’লীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী ও গরিব মানুষের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে তার প্রতি। গোলাম মাওলা রনি ক্ষমতায় থাকাকালীন কোনো দুনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। এ কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে তার যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
এ ছাড়াও গণসংযোগ করছেন ঢাকা মহানগর দণি আ’লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফোরকান মিয়া, দশমিনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগ সভাপতি আব্দুল আজিজ মিয়া, কৃষক লীগের পটুয়াখালী জেলা সভাপতি তসলিম সিকদার। গলাচিপা উপজেলা আ’লীগের সভাপতি সন্তোষ কুমার দে বলেন, ‘বড় দলে গ্রুপিং থাকতেই পারে, তবে নির্বাচন এলে আর নৌকার স্লোগান শুনলে সব বিরোধের অবসান হবে। এটি আ’লীগের আসন, আ’লীগেরই থাকবে।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য দশমিনার সন্তান হাসান মামুন। গলাচিপা-দশমিনায় ২০ দলীয় জোট ও বিএনপির সমর্থকদের কাছে হাসান মামুনের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। শিক্ষিত, সদালাপী ও সুবক্তা হিসেবে দুই উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এ ছাড়াও তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করায় তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তিনি মনোনয়ন পেলে আ’লীগ প্রার্থীর সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ দিকে ‘৭৯-এর নির্বাচন থেকে দশম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ভোটের আধিক্যের কারণে আ’লীগ ও বিএনপি সব সময়ই গলাচিপা উপজেলা থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। ফলে দশমিনার মানুষের মধ্যে রয়েছে এমপি না পাওয়ার বেদনা। বিএনপি যদি দশমিনার কাউকে মনোনয়ন দেয় তাহলে তা আ’লীগের জন্য অশনি সঙ্কেত বয়ে আনতে পারে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আ’লীগ প্রার্থী আ খ ম জাহাঙ্গীর প্রায় ১৩ হাজার ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সূত্র বলছে, এ ১৩ হাজার ভোট এসেছিল দশমিনা, চরকাজল ও চরবিশ্বাস ইউনিয়ন থেকে।
বিএনপি নেতা হাসান মামুন জানান, ’৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি। এবার সৃষ্টি হয়েছে মোম সুযোগ। দল যদি সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন দেয় তাহলে বিজয় অনেকটা নিশ্চিত বলে তিনি মনে করেন। বিএনপি নেতা ও দশমিনা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফখরুজ্জামান বাদল বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে হাসান মামুনকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলে এ আসনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে।’
দশমিনা উপজেলার রনগোপালদি ইউনিয়নের এক বাসিন্দা বলেন, পারিবারিকভাবে আমরা আ’লীগ করি। বিএনপি বিগত নির্বাচনে কোনো ভালো প্রার্থী না দেয়ায় বিএনপি প্রার্থীকে ভোট দেইনি। যদি বিএনপির হাসান মামুন মনোনায়ন পান তাহলে আমি তাকে ভোট দেবো। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসান মানুষ হিসেবে ভালো। তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিতে বিশ^াস করেন। আমি আ’লীগের সমর্থক হলেও বিভিন্ন সময়ে হাসান মামুন ভাইয়ের সততা ও আদর্শের দিক নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লেখালেখি করেছি। তিনি মনোনায়ন পেলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আ’লীগ সমর্থক কর্মী বলেন, হাসান মামুনকে দল দেখে নয়, আমরা ব্যক্তি ও তার সততা, আদর্শের জন্য ভোট দেবো। তিনি যখন ছাত্রনেতা ছিলেন তখন যতটা পেরেছেন সাধারণ মানুষের উপকার করেছেন। তার থেকে মানুষ খালি হাতে ফেরেনি।
বিএনপির মনোনয়ন বিষয়ে আলোচনার টেবিলে আরেক নাম গোলাম মোস্তফা। তিনি জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও গলাচিপা উপজেলা বিএনপির সভাপতি। তিনিও এলাকায় বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক নেতা শাহজাহান খান। তিনি ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন। এ ছাড়া কয়েকবার বিএনপির টিকেটে নির্বাচন করলেও জিততে পারেননি। তিনিও মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
মনোনয়ন ও দলের পদ-পদবীকে কেন্দ্র করে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শাহজাহান খান ও বর্তমান সভাপতি গোলাম মোস্তফার মধ্যে বিরোধ রয়েছে। তাদের এ বিরোধ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। তাছাড়া গোলাম মোস্তফার ভাই উপজেলা আ’লীগের উপদেষ্টা শাহ আলম। এ নিয়েও নানা কথা চালু আছে। তার ভাই শাহ আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে আ’লীগের মনোনয়নের জন্য ব্যাপক লবিং করেও শেষ পর্যন্ত পাননি। পরের দফায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও মনোনয়নের জন্য মাঠে নেমেছিলেন তিনি। শাহজাহান খান বিগত চারটি নির্বাচনে আ’লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হওয়ায় বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা তার প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না।
এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর ১৫ থেকে ২০ হাজার ভোট রয়েছে। তবে এবারের নির্বাচনে তাদের কোনো প্রার্থী নেই। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রায় ২০ হাজার ভোট রয়েছে এ আসনে। আগামী নির্বাচনে দলটি এ আসনে প্রার্থী দিতে পারে বলে জানিয়েছেন দলটির গলাচিপা উপজেলা শাখার সেক্রেটারি মাওলানা মো: জাকির হোসেন। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী থাকবে। আমরা মাঠে কাজ করছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা বিজয়ী হবো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভোট এলে চরমোনাই পীরের বেশির ভাগ মুরিদ ঝুঁকে পড়েন অন্য দলের প্রার্থীর দিকে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement