২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৯ ব্যাংকের অব্যাহত মূলধন ঘাটতি : কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

-

দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের ৯টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না, বরং কোনো কোনোটিতে পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মূলধন ঘাটতির কারণে ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ। এক প্রতিবেদনে মূলধন সংরক্ষণসংক্রান্ত তদারকি কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পরিচালনা করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রম তদারককারী অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগের এক বছরের কার্যক্রমের ওপর গভর্নরের কাছে দেয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়ায় ব্যাংকিং খাতে ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। আর এ ঋণখেলাপির কারণে ঋণের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ। এতে কমছে মূলধন সংরক্ষণের সক্ষমতা।
ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য রোডম্যাপ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৬ সালে দেয়া এ রোডম্যাপ অনুযায়ী চলতি বছরের ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। ইতোমধ্যে তিন বছরের সময়সীমা অতিক্রম হতে চলছে। কিন্তু রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে মূলধন সংরক্ষণ হয়েছে ১০ দশমিক ১১.৬৫ শতাংশ হারে। অথচ এ সময়ে হওয়ার কথা ছিল পৌনে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের আশঙ্কা, রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তি ব্যয় বেড়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯টি ব্যাংক দীর্ঘ দিন যাবৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ১০ শতাংশ থেকে ক্রমান্বয়ে মূলধন সংরক্ষণের হার বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু আলোচ্য প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সোনালী ব্যাংক ২০১৬ সালের মার্চে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ, জুনে ৪ দশমিক শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৭ সালের জুনে ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে এসে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে এসে তা ঋণাত্মক ১ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমেছে।
রূপালী ব্যাংক ২০১৬ সালের মার্চে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, ২০১৭ সালের মার্চে এসে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং ডিসেম্বরের এসে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ২০১৬ সালের মার্চে ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৭ সালের মার্চে এসে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে এসে ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে।
আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ২০১৬ সালের মার্চে ঋণাত্মক ১০৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ২০১৭ সালের মার্চে এসে ঋণাত্মক ১০৮ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে এসে ঋণাত্মক ১১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে।
বেসিক ব্যাংক ২০১৬ সালের মার্চে ঋণাত্মক ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ, ২০১৭ সালের মার্চে এসে ঋণাত্মক ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে এসে ঋণাত্মক ১১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে।
অগ্রণী ব্যাংক ২০১৬ সালের মার্চে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০১৭ সালের জুনে এসে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে।
অনুরোপভাবে সমস্যাকবলিত ফারমার্স ব্যাংক গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং গত ডিসেম্বরে ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পেরেছে।
মূলধন সংরক্ষণের এ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি বছর শেষে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে আলোচ্য ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সামগ্রিক প্রভাব গোটা ব্যাংকিং খাতের ওপর পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বাকি তিন মাসের মধ্যে আলোচ্য ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি রাতারাতি উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়। বরং ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা ও চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ না কমে বরং বেড়ে যেতে পারে। আর তা হলে প্রভিশন ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। এমনি পরিস্থিতিতে চলতি বছর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপ অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের মূলধন সংরক্ষণ সাড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত হওয়া মোটেও সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, মূলধন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকিং খাতের রেটিং খারাপ হবে। ফলে পণ্য আমদানিতে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। ফলে থার্ডপার্টি গ্যারান্টির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হবে। এতে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে।
এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ থেকে মূলধন সংরক্ষণসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছে। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।  

আশরাফুল ইসলাম


আরো সংবাদ



premium cement