২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জন্মহার বাড়াতে অভিনব উদ্যোগ দেশে দেশে

-

মানুষের মৃত্যুর বিপরীতে জন্মহার কমে যাওয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে অনেক দেশে। বছরের পর বছর ধরে জনসংখ্যা কমতে থাকায় ভবিষ্যৎ করুণ পরিণতি এড়াতে নারীদের অধিক সন্তান জন্মদানের জন্য নানা ধরনের উৎসাহমূলক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে অনেক দেশে। সন্তান জন্ম দিলে নগদ আর্থিক সহায়তা এবং পূর্ণ বেতনসহ তিন বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে কোনো কোনো দেশে।
রোমানিয়ার সরকার সন্তান জন্মদানের আগেই মাসিক ভাতা ৮৫ ভাগ বৃদ্ধি, পূর্ণ ভাতাসহ দুই বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটির ঘোষণা দিয়েছে।
এর কারণ ২৫ বছর ধরে বাড়েনি রোমানিয়ার জনসংখ্যা। ২৫ বছর আগে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ। বর্তমানে এটা কমে হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ। ২০৬০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখে কমে আসার আশঙ্কা করা হয়েছে সরকারি তথ্যে।
২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি নারী যাতে ২ দশমিক ১ জন করে সন্তানের অধিকারী হয় সে লক্ষ্যে হাঙ্গেরি সরকার ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিন বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটি, হাউজিং ভর্তুকি, শিশু লালনপালনের জন্য নগদ আর্থিক সহায়তা।
দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৬৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ৫২ ঘণ্টা করা হয়েছে গত জুলাই মাসে। এতে করে কর্মজীবী নারী ও পুরুষ পরিবারে অধিক সময় কাটাতে পারবে এবং এটা তাদের অধিক সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে কাজে আসবে বলে মনে করে সরকার। এ ছাড়া যারা একের অধিক সন্তান জন্ম দেবে তাদের নগদ অর্থ প্রদানেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী চুয়াং হুন জন্মহারের হ্রাসের জন্য নারীদের অতিরিক্ত কাজ করাকে দায়ী করেছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্মহার রয়েছে এরকম শীর্ষ চারটি দেশের তালিকায় নাম রয়েছে এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়ার। দক্ষিণ কোরিয়ায় একজন নারীর গড়ে ১ দশমিক ২ জন সন্তান রয়েছে । ৩৪টি শিল্পোন্নত দেশের সংস্থা ওইসিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার বিশ্বে সবচেয়ে কম। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য একজন নারীর গড়ে ২ দশমিক ১ জন সন্তান থাকা দরকার।
রাশিয়ার নিম্ন জন্মহার নিয়ে চিন্তিত ভøাদিমির পুতিন সরকার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত বছর নভেম্বর থেকে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু করেছেন। নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে নতুন জন্ম নেয়া শিশুর ১৮ মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভরণপোষণ খরচ রাষ্ট্র বহন করবে।
১৯৯২ সাল থেকে রাশিয়ার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ রাশিয়ার জনসংখ্যা বর্তমান ১৪ কোটি ৩৯ লাখ থেকে ১৩ কোটি ২৭ লাখে নেমে আসবে। এ ছাড়া অপর কয়েকটি গবেষনা প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ রাশিয়ার লোকসংখ্যা ১১ কোটি ১০ লাখে নেমে আসবে।
জন্মহার কমে যাওয়ায় ইউরোপসহ অনেক দেশে বেড়ে গেছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা আর কমে গেছে শিশুদের সংখ্যা। গত বছর যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্তুগালে শিশুদের অভাবে ইতোমধ্যে অনেক খেলনার দোকান এবং শিশুদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ পর্তুগালে ১৫ বছরের নিচে শিশুদের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে মাত্র শতকরা ১১ ভাগে। দেশটির ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জ্যাকুইম আজেভেডো বলেছেন, জন্মহার হ্রাসের কারণে যে সঙ্কট তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে পর্তুগালে অস্থিতিশীলতা নেমে আসতে পারে। পর্তুগালে জন্মহার হ্রাস সঙ্কট মোকাবেলায় গঠিত একটি কমিশনের প্রধান তিনি।
স্পেনের পূর্বাঞ্চলে টেরুয়েল রাজ্যের কাস্টেলনু গ্রাম কর্তৃপক্ষ সন্তান জন্ম দিলে বিনামূল্যে বাড়ি এবং একজন বেবিসিটার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে ৮ বছর আগে। এ গ্রামে লোকজন ফিরে এলে তাদের বাড়ি এবং যাতায়াতের ক্ষেত্রে সরকার আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। নারীদের সন্তান জন্মদানের জন্য রেডিওতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী ৪০ বছরে এ রাজ্যের জনসংখ্যা ১০ লাখ কমে যাবে।
ইতালিতে একজন নারীর গড়ে ১.৩ জন সন্তান রয়েছে। নারীদের অধিক সন্তান জন্মদানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সন্তান জন্ম দিলে মাসে ৮০ ইউরো শিশু বোনাস ঘোষণা করা হয়েছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জার্মানিতে কয়েক দশক ধরে জন্মহারের চেয়ে মৃত্যুর হার বেশি। এ ঘাটতি মোকাবেলায় প্রতি বছর ৫ লাখ ৩৩ হাজার অভিবাসীকে স্বাগত জানাতে হবে জার্মানিকে।
ইউরোপের বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং এস্টোনিয়া সরকার প্রবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে ফিরে এলে তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক সদস্য দেশ অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও বাড়াতে পারছে না জনসংখ্যা। কিন্তু তারপরও তারা কোনো বিদেশীদের আশ্রয় না দেয়ার জন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। সে কারণে ইউরোপিয়ান কমিশন গত বছর পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চলতি মাসে পোল্যান্ড অবশ্য অভিবাসী বিষয়ে কঠোর নীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। কট্টর অভিবাসনবিরোধী হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ইউরোপীয় ইউনিয়নের শরণার্থী আশ্রয়দানের নীতির তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, শরণার্থীরা মুসলিম অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থী গ্রহণ করা হলে তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বিপন্ন হবে। জার্মান পত্রিকা ডেইলি বিল্ডের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন গত জুন মাসে।
পপুলেশন ডিকলাইন অ্যান্ড রিমার্কিং অব গ্রেট পাওয়ার পলিটিক্সের সম্পাদক ইয়োশিহারা সম্প্রতি বলেছেন, জন্মহার বাড়াতে না পারলে এসব দেশ বিলীন হয়ে যেতে পারে। গোটা ইউরোপ এবং জাপানের অনেক গ্রাম ইতোমধ্যে ভূতের নগরীতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে অগণিত নারী আছেন যাদের বয়স ৪০ পার হয়ে গেছে কিন্তু এখনো সন্তান জন্ম দেননি। তারা একা থাকতে পছন্দ করেন। তারা সন্তান চান না।
জার্মানিতে অভিবাসীবিরোধী ডানপন্থীরা শেতাঙ্গ গর্ভবতী নারীর পোস্টার ছাপিয়ে তা প্রচার করছে স্থানীয়দের অধিক শিশু জন্ম দেয়ার জন্য।
জাপানের অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে ডেমোগ্রাফিক টাইম বোমার প্রকাশ ঘটেছে। অনেক এলাকায় কয়েকজন করে বয়স্ক মানুষ রয়েছে। যেখানে একসময় জনবহুল ছিল। জন্মহার বাড়াতে জাপান সরকারও নগদ অর্থ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।
ল্যাটিন আমেরিকায় আগামী ৫০ বছরের মধ্যে জনসংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগ কমে যাবে যদি জন্মহার হ্রাসের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে। জনসংখ্যা বাড়াতে কিউবা সরকার গর্ভধারণের পক্ষে পোস্টারসহ বিভিন্ন ধরনের পুস্তিকা বিলি করছে। পপুলেশন রিসার্স ইনস্টিটিউটের সভাপতি স্টিভেন মোশের বলেছেন, আমরা এমন এক পৃথিবী তৈরি করেছি যাকে সামস্টিক আত্মহত্যা কর্মসূচির সাথে তুলনা করা যায়। শিশুদের সংখ্যা ক্রমে কমে যাচ্ছে। এটা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। তার সংস্থা অতিরিক্ত জনসংখ্যা সমস্যা তত্ত্ব এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement