২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নড়বড়ে সংযোগ সড়ক রেখেই চালু হচ্ছে দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু

রংপুরের মহিপুর এবং লালমনিরহাটের কাকিনা সীমান্তে দ্বিতীয় তিস্তা সড়কসেতু : নয়া দিগন্ত -

স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতরের নজিরবিহীন গাফিলতির কারণে পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের নড়বড়ে অবস্থার মধ্যেই আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে রংপুর-লালমনিরহাটের মহিপুর-রুদ্রেশ্বর সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপরের দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটির উদ্বোধন করবেন। এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার এই সেতুটির সংযোগ সড়কের বেহাল দশায় উদ্বিগ্ন সবাই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতুটি চালু হলে ভারী যানবাহনের লোড নেয়ার মতো সক্ষমতা নেই সংযোগ সড়কটির। এ ছাড়া নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে যেকোনো মুহূর্তে সড়কটি পুরোটাই ধসে গেলে কোনো কাজে আসবে না বহুল কাক্সিক্ষত তিস্তা সড়ক সেতুটি।
সেতুর দাবি : স্থানীয়রা জানান, লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর, পাটগ্রম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলার লাখ লাখ মানুষকে রংপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে লালমনিরহাট হয়ে ঘুরে আসতে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ বেশি পাড়ি দিতে হয়। এতে অনেক বেশি সময় ও অর্থ অপচয় হয়। এ কারণে বিগত ৪৫ বছর ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর এবং লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের রুদ্রেশ্বর সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছিলেন ভুক্তভোগীরা। অবশেষে ২০১০ সালে দাবি পূরণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে সরকার।
যেভাবে শুরু হলো দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতুর কাজ : স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) রংপুর জোনাল অফিস সূত্র জানায়, দীর্ঘ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে (একনেক) বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরে গ্রামীণ যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এবং লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের রুদ্রেশ্বর সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর ৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ফুটপাথসহ ৯ দশমিক ৬ মিটার প্রস্থের দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য ১২১ কোটি ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করে সরকার। এরপর টেন্ডার আহ্বান করা হলে সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ দেয়া হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ডব্লিউ এমসিজি নাভানা কনস্ট্রাকশনকে। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেতুটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন সেই সময়কার এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এলজিইডি সূত্র মতে, একনেকে পাস হওয়া বরাদ্দে শিডিউল অনুযায়ী ৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটির প্রস্থ ৯ দশমিক ৬ মিটার। যানবহন চলাচলের জন্য বরাদ্দ আছে ৭ দশমিক ৩ মিটার। দুই পাশে ফুটপাথ আছে ০ দশমিক ৯ মিটার। সেতুটিতে ১৬টি পিলার, দু’টি অ্যাপার্টমেন্ট, ১৭টি স্প্যানে ৮৫টি গার্ডার আছে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার। এ ছাড়া আছে সেতুটির উভয় পাশে এক হাজার ৩০০ মিটার নদী শাসন বাঁধ নির্মাণ এবং সেতুর উত্তর প্রান্ত থেকে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের কাকিনা পর্যন্ত ৫ দশমিক ২৮০ কিলোমিটার সড়ক ও দু’টি ব্রিজ, তিনটি কালভার্ট নির্মাণ, সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে রংপুরের অংশে ৫৬৩ মিটার সড়ক নির্মাণ। শিডিউল অনুযায়ী এসব কাজই ২০১৪ সালের ৩১ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু এলজিইডি এবং ঠিকাদারি কর্তৃপক্ষের নানা অজুহাতে তিন দফা সময় ও নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে সেতুটির কাজ শেষ করে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এতে সেতুটির মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়।
এলজিইডি সূত্র জানায়, প্রথমে সেতু নির্মাণে ২২ মাস সময় ধরা হলেও ২০১৪ সালের ৩১ জুন মেয়াদ শেষে সেতুর মাত্র ৪৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ায় এলজিইডি। প্রথম দফা সময় বৃদ্ধির মেয়াদে সেতুর মাত্র ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়। ফলে আবারো ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। তাতেও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয়বারের মতো সময় বাড়ানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করে কালিগঞ্জ এলজিইডিকে বুঝিয়ে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাভানা।
এ ব্যাপারে নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রকৌশলী মো: মকবুল হোসেন জানান, আমরা সেতু এবং সংযোগ সড়কের কাজ শেষ করে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে লালমনিরহাট এলজিইডির কাছে হস্তান্তর করেছি। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা।
এ দিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতুটি এলজিইডিকে বুঝিয়ে দেয়ার পরপরই সেতুটির উত্তর পান্ত থেকে কাকিনা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ধসে যেতে থাকে। এরই মধ্যে গতিপথ বদলায় তিস্তা। গত জুলাই মাসে সংযোগ সড়কে ধস মহামারী আকার ধারণ করে। দায় এড়াতে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান তড়িঘড়ি করে সেতু ও সড়কটি স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল দফতর রংপুরের কাছে বুঝিয়ে দেন।
নড়বড়ে সংযোগ সড়ক ধসে গেলে অকেজো হবে সেতু শিডিউল অনুযায়ী একনেকে পাস হওয়া বরাদ্দের মধ্যেই সেতুর উত্তর প্রান্ত থেকে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের কাকিনা পর্যন্ত ৫ দশমিক ২৮০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে দু’টি প্যাকেজে চার কোটি ৪৬ লাখ ও এই সড়কে দু’টি ব্রিজ ও তিনটি কালভার্ট নির্মাণে তিনটি প্যাকেজে ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে রংপুরের অংশে ৫৬৩ মিটার সড়ক নির্মাণে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এত বিপুল টাকা এই কাজে ব্যয় করা হলেও চলতি জুন-জুলাই মাসের বন্যায় সেতুটির উত্তর প্রান্ত থেকে কাকিনা পর্যন্ত সংযোগ সড়কের বেশির ভাগ স্থান ধসে যায়। চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে এই সড়ক।
অনুসন্ধানে এলজিইডি, স্থানীয় মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কটিতে ২ ফুট এঁটেল মাটি দেয়ার কথা থাকলেও শুধু বালুর ওপর নি¤œœমানের খোয়া দিয়ে দায়সাড়া কাজ করা হয়েছে। সে কারণে সড়কটি ধসে যাচ্ছে।
এলজিইডির একাধিক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী নয়া দিগন্তকে জানান, সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর থেকেই এর ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন বাস-ট্রাক, ট্যাকংলরি যাতায়াত শুরু করবে। বিশেষ করে প্রতিদিন শত শত পাথরবাহী ভারী ট্রাক যাতায়াত করবে। এসব ভারী যানবাহনের লোড কোনোভাবেই নড়বড়ে ওই সংযোগ সড়কটি নিতে পারবে না। কারণ ওই সংযোগ সড়কটি বালু দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে। ওপরে এঁটেল মাটি দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় নি। এ ছাড়া তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার কারণে যেকোনো মুহূর্তে তিস্তার রুদ্রমূর্তির ঢেউ আঁচড়ে পড়বে সড়কটির ওপর।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রংপুর চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাশেম নয়া দিগন্তকে জানান, এই সেতু নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বুড়িমারী স্থলবন্দরকে আরো বেশি কার্যকর করা। ব্যবহার করা। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে আমাদের যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য আছে সেটি এই সেতুর মাধ্যমে আরো সম্প্রসারণ হবে। এই অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই অঞ্চলের মানুষ সাধুবাদ জানায়। কিন্তু সেতুটির লালমনিরহাট অংশের সংযোগ সড়ক এবং ব্রিজ ও কালভার্ট নি¤œœমানের কাজের কারণে যেভাবে ধসে যাচ্ছে তাতে আমরা শঙ্কিত।
সংযোগ সড়ক নির্মাণে নি¤œমানের কাজ ও ধসে যাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি কালিগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান। তবে তিনি বলেন, নদী প্রতি মুহূর্তে গতিপথ পরিবর্তন করে থাকে। সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার সময়ের গতিপথ অনুযায়ী সেতু ও নদী শাসন বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এখন নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সেটা দেখার কাজ আমার নয়, এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ। তারা দেখবে।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম জাকিউর রহমান দাবি করেছেন সম্প্রতি বন্যায় তিস্তা দ্বিতীয় সড়ক সেতুর সংযোগ সড়কের ব্রিজের কিছু অংশ ধসে গেছে। বালুর বস্তা ফেলে সংযোগ সড়ক ভাঙন ও ধস ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
জনগণের চাপে উদ্বোধনের আগেই সেতু দিয়ে চলাচল নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে স্থানীয়দের চাপে চলতি বছরের মার্চ মাসে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এলজিইডি এবং পুলিশের সাথে আলাপ আলোচনা করে সেতুটি সাময়িকভাবে শুধু পথচারী ও মোটরসাইকেল আরোহীদের জন্য খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
এলজিইডি প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা নয়া দিগন্তকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন ১৬ সেপ্টেম্বর। সেতুটি চালু হলে রংপুর-লালমনিরহাটের অর্থনীতির চাকা খুলে যাবে। এই অঞ্চলের মানুষ আগে তাদের উৎপাদিত পণ্য ঢাকায় নিয়ে যেতে যেতেই পচে যেত। এখন সেটা হবে না। অন্তত ৬০ কিলোমিটার পথ কমে যাবে। এই অঞ্চলে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।


আরো সংবাদ



premium cement