২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে নিরাপত্তা

মূলধন সংরক্ষণে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ

ভারতের ১৩.৯ পাকিস্তানের ১৫.৮ শ্রীলঙ্কার ১৫.২ বাংলাদেশের ১০.৮
-

দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের মধ্যে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণে পিছিয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। গত বছর ভারতের ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করেছিল ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ১৫ দশমিক ২ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সংরক্ষণ করেছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে মূলধন সংরক্ষণের এ চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতাই ফুটে ওঠে। এর ফলে শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। বিদেশী বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর সাথে বিদেশী ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। এতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে গ্যারান্টি হিসেবে তাদের বাড়তি ফি দিতে হয়, যার প্রভাবে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য রোডম্যাপ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সালে দেয়া এ রোডম্যাপ অনুযায়ী চলতি বছরের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। ইতোমধ্যে চার বছরের সময়সীমার তিন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মূলধন সংরক্ষণ হয়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ হারে, যা আগের বছরের ডিসেম্বরে একই ছিল। অথচ এ সময়ে হওয়ার কথা ছিল পৌনে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ জন্য প্রধান বাধা হিসেবে দেখছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এ কারণেই আন্তর্র্জাতিক মানদণ্ডে দেশের ব্যাংকিং খাত পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে ঊর্ধ্বমুখী খেলাপি ঋণ। আর এ খেলাপি ঋণের আধিক্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর বেশি। এ কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। ফলে মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। আর এর পুরো প্রভাব পড়েছে গোটা ব্যাংকিং খাতে।
গত কয়েক বছর সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ, এনন টেক্স, বেসিকসহ বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। ওইসব ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের খাতায় মন্দঋণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু এসব মন্দঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে গেছে।
এ দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি ও লুটপাটের দায় জনগণের ঘাড়েও চাপানো হচ্ছে। কেননা, দুর্নীতির দায় মেটানো হচ্ছে জনগণের অর্থ দিয়ে। গত তিন বছরে সরকারি ৬ ব্যাংকের ভর্তুকি দেয়া হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
মূলধন ঘাটতি সামনে আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পূর্বাভাসে দেখা গেছে, ২০২০ সালের মধ্যে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও শরিয়াহ্ভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ত বর্তমান অবস্থায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। অপর দিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা বর্তমান অবস্থা থেকে কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তা বর্তমান অবস্থা থেকে আরো হ্রাস পেতে পারে। তবে বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ হার বর্তমান অবস্থা হতে বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা দুই বছর আগেই অতিক্রম করতে পেরেছে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সামগ্রিক প্রভাব গোটা ব্যাংকিং খাতের ওপর পড়েছে। চলতি বছর শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি রাতারাতি উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। বরং ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা ও নানা কারণে সরকারি ব্যাংকসহ সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ না কমে বরং বেড়ে যেতে পারে। আর এটা হলে প্রভিশন ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। এমনি পরিস্থিতিতে চলতি বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপ অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের মূলধন সংরক্ষণ কিভাবে সাড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, মূলধন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকিং খাতের রেটিং খারাপ হবে। ফলে পণ্য আমদানিতে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। ফলে থার্ডপার্টি গ্যারান্টির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হবে। এতে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকরে প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি উন্নতি করতে হলে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্কতার সাথে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement