১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচন নিয়ে আস্থার সঙ্কট কি বাড়ছে

জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছে দলগুলো
-

বাংলাদেশে রাজশাহী, সিলেট এবং বরিশালÑ এই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাঠে এখন রাজনৈতিক দলগুলো তুমুল লড়াইয়ে নেমেছে। জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে দলগুলো। তবে গাজীপুর এবং তার আগে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ধরনের কারচুপির অভিযোগ উঠেছে, তার ফলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে আস্থার সঙ্কট বা সন্দেহ কি আরো বাড়বে? সেই প্রশ্ন এখন উঠছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি নিজেই বেশ কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে ঘুরে নানা অনিয়ম দেখেছিলাম। গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আমি যে কেন্দ্রগুলোয় গিয়েছিলাম, তার অনেক কেন্দ্রে বিরোধী দল বিএনপির মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না।
একটি কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টকে বের করে দেয়ার পর তারা সেখানে প্রতিবাদ করলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে নৌকা মার্কায় সিল মারার ঘটনা দেখারও অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একটি কেন্দ্রে আমার সাংবাদিক পরিচয় বুঝতে পেরে কয়েকজন যুবক সিল মারা ব্যালটগুলো একসাথে বাক্সে ভরে দ্রুত কেন্দ্র ত্যাগ করেছিল। এর আগে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে বিরোধী দল বিএনপি।
এখন তিনটি সিটি করপোরেশন রাজশাহী, সিলেট এবং বরিশালে ৩০ জুলাই যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে।
কিন্তু বিএনপিতে নির্বাচনীপ্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ বা আস্থার সঙ্কট বেড়েছে।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, ক্ষমতাসীনেরা সচেতনভাবেই নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে বিতর্কিত নির্বাচন করছে।
‘নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই নির্বাচন কমিশন কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারে না। এবং তারা কিছুই করতে পারে না। একটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। আমরা বার বার অভিযোগ করার পরও বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে গাজীপুরে তারা কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। প্রত্যেকটি জায়গায় একই ঘটনা ঘটছে। কেন্দ্রগুলো দখল করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এজেন্টদের থাকতে দিচ্ছে না।’
‘এ সরকার তো অত্যন্ত সচেতনভাবে এই প্রতিষ্ঠানটিকে শেষ করে দিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা আর কখনো সুস্থ হবে বলে আমাদের মনে হয় না।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র এবং মাঠপর্যায়ের নেতাদের অনেকের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা নির্বাচন নিয়ে অভিযোগগুলো আমলে নিতে চাইছেন না।
তাদের একটা বড় অংশ নির্বাচনগুলোয় প্রতিপক্ষকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থেকেও অনেকটা দূরে সরে এসেছে।
এমন প্রেক্ষাপটেই নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার দাপট খাটানোর অভিযোগও উঠছে।
কিন্তু তা মানতে রাজি নন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি মনে করেন, কোনো নির্বাচন হলেই বিএনপি তাকে বিতর্কিত করছে।
‘গাজীপুর এবং খুলনা নির্বাচন নিয়ে যে কেউ কেউ বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে, সেটা সমীচীন নয়। কারণ আমরা যদি ভোটের গড় হার দেখি, দুই জায়গাতেই ৬০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে। আমরা যদি আমাদের দেশের যেকোনো নির্বাচনের ভোটের হারের সাথে তুলনা করি, তাহলে এই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হয়েছে।’
‘যত নির্বাচনই আসুক, যখনই বিএনপি বিরোধী দলে থাকে, তখন সব নির্বাচনকেই তারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। যেমন বিএনপি শাসনামলে কোনো উপনির্বাচনে আমরা কখনো বিজয়ী হইনি। কিন্তু আমাদের সময় বিএনপি বগুড়ায় জিতেছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এমনকি বিএনপির লিস্ট থেকেও কমিশনার হয়েছে। কিন্তু কমিশনে শুরু থেকেই বিএনপি সব কিছুকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।’
গাজীপুর এবং খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি, বিশ্লেষকদের অনেকে তা মনে করেন।
কারণ হিসেবে তারা দেখেন, মামলা বা গ্রেফতারের ভয়ে নির্বাচনী মাঠে বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীরা সেভাবে থাকতে পারেনি। এরপরও সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো যে অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীনরা খুশি বলে মনে হয়।
কিন্তু নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ফেমার প্রধান মুনিরা খান মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে আস্থার সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
‘জাতীয় নির্বাচন তো একেবারেই কাছে। তো নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা সবার জন্য প্রযোজ্য। এটা শুধু দলগুলোর কথা বলব না। আমি বলব, দল, প্রার্থী এবং ভোটার সবার কাছেই কিন্তু দেখার বিষয়। এবং এটা একটা নির্বাচন কমিশনের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ যে, এই তিনটা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করলে তাদের প্রতি সবার একটা আস্থা গড়ে উঠবে।’
মুনিরা খান যেমনটা মনে করছেন, সামনের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার মধ্য দিয়ে একটা আস্থার পরিবেশ তৈরি সুযোগ এখনো রয়েছে।
একইভাবে পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা।
‘পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে কিন্তু যে জিনিসটা দেখেছি, জনগণের মধ্যে প্রশ্ন আছে। কোনো কারণে যদি এগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে জনগণের মধ্যে আস্থার জায়গায় একটা সঙ্কট তৈরি হয়। সুতরাং জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখন আগামী নির্বাচনগুলোতে যদি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে পারে। তাহলে জনগণের মধ্যে আস্থার যে একটা সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, সেই জায়গা থেকে কিন্তু সরকার বেরিয়ে আসতে পারবে।’
বিএনপি বিভিন্ন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন তুলে আসছে। সাধারণত এটিকে রাজনৈতিক অঙ্গনের বিতর্ক দেখা হয়।
কিন্তু এখন নির্বাচন কমিশন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আস্থার সঙ্কট তৈরি হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। তবে একথা মানতে রাজি নয় নির্বাচন কমিশন।
তারা মনে করছে, কমিশন মানুষের আস্থার জায়গায়ই রয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা যে ব্যবস্থা নিচ্ছেন, সেটা বিবেচনা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
‘নির্বাচনে অনিয়ম হতে পারে। যারা অনিয়ম করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রয়োজনে কেন্দ্র বন্ধ করা সহ প্রশাসনিক সব ব্যবস্থা নেয়া হয়। সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে নির্বাচন হবে, কেউ বিতর্ক করবে না, এটা যারা বিতর্ক করবে তাদের ব্যাপার। আমাদের দায়িত্ব হলো, সংবিধান, আইন বা বিধান সব প্রয়োগ করে আমরা নির্বাচন করব।’
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার দাবি বিএনপি এখনো তুলছে। কিন্তু দলটির নেতৃত্বের একটা অংশ মনে করছে, আওয়ামী লীগ সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হবে।
সেই প্রেক্ষাপটে তাদের দলের প্রস্তুতি নেয়ার একটা চেষ্টা রয়েছে।
আর এর অংশ হিসেবে তারা সিটি নির্বাচনগুলোয় অংশ নিচ্ছে। পাশাপাশি তারা নির্বাচনীপ্রক্রিয়ার সমস্যাগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে একটা সমাধানে আসার চেষ্টা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তারা করে যাবেন।
‘আমাদের খুব পরিষ্কার কথা, আমরা ভাবছি, এ সরকারের অধীনে কখনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। আমরা একথা বলছি। একটা গণতান্ত্রিক পার্টি আর কী করতে পারে। একটা গণতান্ত্রিক পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা, ব্যাপারটা খুব অসম লড়াই হয়। তারপরও এ কথাগুলো আমরা বলে যাচ্ছি। আমরা জেলে যাচ্ছি। আমাদের নেত্রী এখন জেলে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা। আমরা আমাদের চেষ্টা তো করছি। এখন জনগণের দায়িত্ব রয়েছে তাদের অধিকার আদায় করে নেয়া।’
জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, সেই প্রেক্ষাপটে যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের সম্ভাবনাকে সরকার সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে কথা বলেও মনে হয়েছে যে, বিএনপি বড় কোনো আন্দোলন বা রাজনৈতিক কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারবে, সেটা তারা মনে করেন না।
সে কারণে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট থাকতে পারে, তা বিশ্বাস করতে চান না ক্ষমতাসীনেরা।
তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সন্দেহ দূর করা সম্ভব নয় বলে তারা মনে করেন।
‘কোনো কিছু করেই বিএনপিকে আস্থায় আনতে পারবেন না। বিএনপি সবকিছু নেগেটিভ দৃষ্টিতে দেখে।’
‘জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রশাসনের কর্তৃত্ব থাকবে নির্বাচন কমিশনের হাতে। প্রধানমন্ত্রী শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন। বিএনপি যদি সুস্থ রাজনীতি করতে চায়, তাহলে এখনই তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতো। কিন্তু তারা সেটা করবে না। তারা যখন করবে, তখন সময় থাকবে না।’
কিন্তু সামনের তিনটি সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কি মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারবে? এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
মুনিরা খান মনে করেন, সরকার সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে চললে আইনে নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে।
‘সংবিধানে এবং আইনে নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেয়া আছে, তাতে তারা কিন্তু একদমই সুষ্ঠু ও ভালো নির্বাচন করতে পারে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও দাবি করেন, তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। তিনটি সিটি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার মাধ্যমে তারা জাতীয় নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান।
ঢাকার নিউমার্কেটের সামনে রাস্তায় আমি এখন সাধারণ মানুষের কয়েকজনের সাথে কথা বলছি। তাদের অনেকে বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাদের মধ্যে নির্বাচনীপ্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ আরো বাড়িয়েছে।
বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরিজীবী মো: আবদুল্লাহ বলেছেন, ভোট দিয়ে কী হবে, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে তার মনে। সেজন্য তিনি তার এলাকার পৌর নির্বাচনে ভোট দেননি।
এই একই ধারণা হয়েছে চাকরিজীবী আঞ্জুমান আরার।
‘আমি ভোট কেন্দ্রে যাব কি না বা ভোট দিলে কী হবে? আমিও ব্যাপারটা নিয়ে সন্দিহান।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী বলছিলেন, ‘দেখা যাচ্ছে যে নির্বাচনে ভোট কারচুপি হচ্ছে। আমরা কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই আমাদের ভোট দিয়ে দিচ্ছে। আমরা সব মেনে নিচ্ছি। এর প্রভাব কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে পড়বে।’
এক দিকে বিরোধী দলকে দুর্বল হিসেবে দেখা, অন্য দিকে খুলনা ও গাজীপুরের সাফল্যকে ভবিষ্যৎ নির্বাচনের মানদণ্ড হিসেবে নেয়ার যে ঝুঁকি, সে সম্পর্কে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন।
কিন্তু ভোটের দিনে সাধারণ মানুষ যদি ব্যালট বাক্স পর্যন্ত পৌঁছতে না পারেন, তাহলে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার তাদের হারানো বিশ্বাস রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে ফিরিয়ে আনবে, তার জবাব নেই কারো কাছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement