২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শুধু সেচেই আমনে অতিরিক্ত খরচ ৬০০ কোটি টাকা

উদ্বিগ্ন চাষিরা
রংপুরে পানির অভাবে আমন লাগাতে পারছেন না কৃষক। রংপুরের পাগলাপীর এলাকা থেকে তোলা ছবি : নয়া দিগন্ত -

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতি। এই অঞ্চলে কয়েক দিন ধরে মরুভূমির উত্তাপ। এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৭ শতাংশ কম। পানির স্তুর নিচে নেমে গেছে। ফলে আমন লাগানো এবং পাট পচানোর এই ভরা মওসুমে গরমে বিবর্ণ হয়ে গেছে মাঠ-ঘাট। ভরা মওসুমের দেড় মাসেও এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ জমিতেই আমন রোপণ করতে পারেননি কৃষক। যতটুকু লাগানো হয়েছে তারও অর্ধেক লাগাতে হয়েছে অতিরিক্ত সেচ দিয়ে। ফলে যেখানে আমনের আবাদ সেচ ছাড়া হওয়ার কথা সেখানে কৃষকদের সেচ বাবদ গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৬০০ কোটি টাকারও বেশি। তবুও কৃষি বিভাগের প্রায় ১৭ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে আমন লাগানোর পরিকল্পনা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুর জোন সূত্রে প্রকাশ, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবার আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২১ লাখ হাজার ২৩৯ হেক্টর জমিতে। এই পরিমাণ জমি থেকে এবার ৪৭ লাখ ৫৮ হাজার ৪৩৭ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে কৃষি বিভাগের। লক্ষ্য বাস্তবায়নে এই পরিমাণ জমিতে আমন রোপণের জন্য এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই বীজতলা তৈরির পর মধ্য জুন থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত জমিতে চারা রোপণ করার কথা কৃষকদের। কিন্তু পানির অভাবে বীজতলার আমন চারা জমিতে রোপণ করতে পারছেন না কৃষক।
রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না গত দেড় দশক ধরে। ফলে আমনের বীজতলা ও চারা রোপণের ভরা মওসুম জুন মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ৪৩৭ ও জুলাই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ৪৫৭ মিলিমিটার হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৫ বছরে আবহাওয়া অফিসের রেকর্ডে তা মিলেছে অর্ধেকেরও অনেক কম। চলতি বছর জুন মাসে এই অঞ্চলে গড়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৬১ দশমিক ৫ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম। অন্য দিকে জুলাই মাসের ২০ দিনে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৬২ দশমিক ১ মিলিমিটার। এই বৃষ্টিও হয়েছে এই মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে। এরপর থেকে বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হিসাবে জুলাই মাসে এই বৃষ্টির পরিমাণ ৮৭ শতাংশ কম।
উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিক খামারবাড়িগুলোর রেকর্ড অনুযায়ী এই অঞ্চলের চার জোনে এ পর্যন্ত এই অঞ্চলের আমনের আবাদ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে। ১২ লাখ ৩৬ হাজার জমি এখনো অনাবাদিই আছে।
আমন ও পাটচাষিদের বিবর্ণ দশা
পরিবেশবিদ, চাষি ও কৃষি বিশেষজ্ঞেরা নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আমনের আবাদ কৃষকদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং মওসুমের বোনাস আবাদ হিসেবে পরিচিত। কারণ আমনে বৃষ্টির পানি দিয়েই গোলায় ধান তোলেন কৃষক। কিন্তু সেই পরিস্থিতি গেল ১৫ বছর থেকে এই অঞ্চলে নেই। লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকই অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।
সরেজমিন দেখা গেছে, রোপিত আমন চারা পানির অভাবে, রোদের পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে। পানি নেই কোথাও। অনেক কৃষক জমিতে হাল দিয়ে রেখেছেন; কিন্তু চারা লাগাতে পারছেন না। অনেকে এখনো জমিতে হালই দিতে পারেননি।
সরেমজিন পরিদর্শনে বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা জানিয়েছেন, ২৪ শতকের এক দোন জমিতে সেচ দেয়ার পেছনে খরচ হচ্ছে ৬০০ টাকা। প্রতি ঘণ্টায় ১২০ টাকা দিতে হচ্ছে শ্যালো মেশিন মালিকদের। এই হিসেবে যে জমি আবাদ হয়েছে, তাতে সেচ দিতে এখন পর্যন্ত কৃষকের শুধু সেচেই বাড়তি খরচা গেছে ১৪৮ কোটি টাকা। আর বৃষ্টি না হলে অনাবাদি পড়ে থাকা বাকি জমিতে সেচ দিয়ে আমন আবাদ করতে লাগবে ৩৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এবার ধানের দাম না থাকলেও আমনে শুধু সেচ দিতেই কৃষকের টাকা খরচা হবে ৬০০ কোটি টাকার ওপরে।
বিশিষ্ট কৃষি বিশ্লেষক এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রংপুর জেলা সেক্রেটারি আফতাব হোসেন জানান, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উত্তরাঞ্চলে ভূমির উচ্চতা ৭০ ফিট। সেকারণে বৃষ্টি না হলে এই অঞ্চলের ভূ-স্তরে পানি থাকে না। এ জন্য এই অঞ্চলে জমিতে পানি নেই। কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তারা আমন লাগাতে পারছেন না। সামর্থ্যবান কৃষকেরা খরচা করে সেচ দিয়ে আমন লাগালেও সেই জমিতে পানি থাকছে না। বৃষ্টি না হলে এবার আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এই কৃষি বিশ্লেষক।
রংপুর পাগলাপীরের কৃষক গোলাম রসুল জানান, আমি ঋণ করে টাকা নিয়ে দেড় একর জমিতে শ্যালো মেশিন সেচ দিয়ে আমন লাগাচ্ছি। অনেক কৃষক এখনো জমিতে হাল দিতে পারেননি। নুরুল ইসলাম নামের এক কৃষক জানালেন, সেচ দিয়ে জমিতে চারা লাগিয়েছি। এখন আবার চারা বাঁচানোর জন্য সেচ দিচ্ছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শাহ আলম নয়া দিগন্তকে জানান, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখনো ২৫ শতাংশ জমিতেই আমন লাগানো সম্ভব হয়নি। অনেক চাষি সেচ দিয়ে আমন লাগাচ্ছেন। কারণ সঠিক সময়ে লাগাতে না পারলে আমনের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে না। তিনি জানান, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ জমিতে আমন লাগানো সম্ভব হবে। কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত না হলে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংশয় আছে এই কৃষিবিদের।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল