২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কর্জে হাসানায় স্বাবলম্বী হচ্ছেন কুড়িগ্রামের ৭ শতাধিক বিধবা

কর্জে হাসানা প্রকল্পে কাজ করছেন বিধবা মহিলারা : নয়া দিগন্ত -

কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা উলিপুরের ফরাজীপাড়ার শামসুন্নাহার বেওয়া। ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন প্রতিবেশী হাফেজ মিয়াকে। বিয়ের পর স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছিল তাদের জীবন। হাফেজ মিয়া কুষ্টিয়া থেকে পান কিনে এনে উলিপুর বাজারে পাইকারি বিক্রি করতেন। সচ্ছল জীবনে জন্ম নেয় দুই সন্তান। কিন্তু শামসুন্নাহারের এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন হাফেজ মিয়া। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীর অকাল মৃত্যুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। দুই সন্তানের ভরণ পোষণ করার মতো কোনো সঞ্চয় ছিল না তার। সন্তানদের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিতে অন্যের বাড়ি ঝিয়ের কাজ নেন শামসুন্নাহার। এ সময় নানান নির্যাতনও সহ্য করতে হয় তাকে।
নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার পর আবারো সুদিন ফিরছে শামসুন্নাহারের। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ইসলামিক রিলিফের (ইউকে) আলো প্রকল্পের কর্জে হাসানায় তার সুদিন ফিরতে থাকে। প্রকল্প থেকে তাকে দেয়া হয় ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা ও প্রাণিসম্পদের ওপর প্রশিক্ষণ। এরপর ব্যবসা শুরুর জন্য দেয়া হয় ২০ হাজার টাকা কর্জে হাসানা। এই টাকা দিয়ে তিনি একটি গরু ক্রয় করেন। এক বছর লালন-পালন করার পর সেটি বিক্রি হয় ৫২ হাজার টাকায়। এর মধ্যে ১৮ হাজার টাকা দিয়ে পুনরায় একটি বকনা বাছুর ক্রয় করেন। সেখান থেকে বর্তমানে তার দুটি গরু আছে। এ ছাড়াও বাকি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বন্ধকী জমি ছাড়ান এবং ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বসতঘর মেরামত ও চার হাজার টাকা গরুর খাবারের জন্য রাখেন।
পরবর্তীতে দ্বিতীয়বারের মতো কর্জে হাসানা নেন প্রকল্প থেকে। এবার এই টাকা দিয়ে তিনি ১০ শতক জমি বন্ধক নেন। এখন তার সাকল্যে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ২০ শতক। যেখান থেকে তিনি সারা বছরের ধানের চাহিদা মেটান। এ ছাড়াও বসতবাড়িতে সবজি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে সবজি চাষ করে নিজের সব্জির চাহিদা পূরণ করছেন।
এখন তার বড় ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করেন এবং ছোট ছেলে প্রকল্প থেকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছেন। যা দিয়ে তার পড়ালেখার খরচ মিটছে।
দারিদ্র্যকে জয় করে স্বাবলম্বী হওয়া আরেক সংগ্রামী নারীর নাম রিনা বেগম। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় জন্ম নেয়া এই নারীর পরিবারের সচ্ছলতার অভাবে অল্প বয়সেই বিয়ে হয় উলিপুর উপজেলার রিকশাচালক মজনু মিয়ার সাথে। মজনু মিয়া দিন মজুরি ও রিকশাচালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এর মধ্যে জন্ম নেয় রিনা-মজনু দম্পতির দুই মেয়ে মৌসুমি ও মিমি এবং ছেলে রানা মিয়া। ২০১০ সালে মজনু মিয়া হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর রিনার জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ যন্ত্রণার দিন। স্বামীর কোনো জমিজমা বা সঞ্চয় না থাকায় তিন সন্তানের মুখে দুই বেলা আহার জোটাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে কিছু সহায়তা পেলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। অভাবের কারণে বড় মেয়ে মৌসুমিকে দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাল্যবিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ সময় ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ দুর্গাপুর ইউনিয়নে কাজ শুরু করে। রিনা বেগমের পরিবার এতিম সুবিধাভোগী হিসেবে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নেতৃত্ব উন্নয়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, গাভী পালন, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এরপর প্রকল্প থেকে তাকে গরু ক্রয়ের জন্য ২০ হাজার টাকা কর্জে হাসানা দেয়া হয়। এর সাথে তার সঞ্চয় এক হাজার টাকা দিয়ে ২১ হাজার টাকায় একটি গরু ক্রয় করেন। এটি আট মাস লালন পালন শেষে ৪৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
এই টাকার সাথে আরো দুই হাজার টাকা সঞ্চয় যোগ করে ৫০ হাজার টাকায় ১৮ শতক জমি লিজ নেন রিনা। এ ছাড়াও প্রকল্প থেকে দ্বিতীয় দফায় আরো ২৫ হাজার টাকা কর্জে হাসানা গ্রহণ করেন। এই টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় একটি ষাঁড় গরু ও তিন হাজার টাকায় একটি ছাগল ক্রয় করেন। বাকি দুই হাজার টাকা তার সন্তানের পড়ালেখার কাজে ব্যয় করেন।
এ ছাড়াও প্রকল্পের শিক্ষাবৃত্তি সহায়তা থেকে ৫০০ টাকা পাচ্ছে তার সন্তানরা। বর্তমানে তার বড় মেয়ে মৌসুমি বিএ প্রথম বর্ষে, ছোট মেয়ে মিমি অষ্টম শ্রেণী এবং ছেলে রানা মিয়া চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশুনা করছে। রিনা বেগম ইউনিয়ন স্বাবলম্বন নারী ফোরামের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগের ফলে তাকে স্বপ্ন প্রকল্পের কাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। ফলে সেখান থেকেও প্রতিদিন ২০০ টাকা করে উপার্জন করছেন।
এখন স্বাবলম্বী এই নারীর একটি গরু, ১৮ শতক জমি লিজ, দুইটি ছাগল, পাঁচটি মুরগি ও ছয়টি হাঁস রয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৯০ হাজার টাকা।
ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ ২০১৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে অলটারনেটিভ অরফান ফ্যামিলি স্পন্সরশিপ প্রোগ্রাম থ্রো সাসটেইনেবল লিভলিহুড প্রকল্পটি ইসলামি রিলিফ ইউকের সহায়তায় কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলায় অসহায় ও এতিম শিশু পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক মর্যাদা পুনঃস্থাপন এবং অধিকার ও ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ৭৯০টি অসহায় এতিম পরিবারকে ৪৮ মাস সেবা প্রদান করা হবে।
বর্তমানে প্রকল্পের অধীনে বুড়াবুড়ী ইউনিয়নে ১৬১, দুর্গাপুর ইউনিয়নে ১৭৫, পাণ্ডুল ইউনিয়নে ৮৪, হাতিয়া ইউনিয়নে ১৪৯, ধরণীবাড়ী ইউনিয়নে ১৩১ জন এবং দলদলিয়া ইউনিয়নে ৯০ এতিম পরিবারসহ মোট ৭৯০ উপকার ভোগী রয়েছেন। এ ছাড়াও স্থানীয় সহায়তায় তবকপুর ইউনিয়নে ১৫৩ জন এবং ধামশ্রেণী ইউনিয়নে ১২৫ জন উপকার ভোগী রয়েছে।
প্রত্যেক অসহায় শিশু প্রতি মাসে পাচ্ছে ৫০০ টাকা লেখাপড়ার খরচ হিসেবে এবং তার পরিবার কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরে ব্যবসা করার জন্য এক কালীন ২০ হাজার টাকা কর্জে হাসানা প্রদান করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে তারা জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারবেন এবং প্রকল্পের মেয়াদ শেষে এ শিশুদের লেখাপড়া করানোর ব্যয় বহন করতে পারবেন। আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি শিশুদের গুণগত শিক্ষা, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ও নিশ্চিত করা হচ্ছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement