১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
কাল থেকে আমরণ অনশন নন-এমপিও শিক্ষকদের

নীতিমালার কঠিন শর্তের আবর্তে নতুন এমপিওভুক্তি

* নীতিমালা মেনে এক হাজার প্রতিষ্ঠানে এমপিও দেয়া হবে * শর্তকে ‘নতুন করে বাধা আরোপ’ বলে অভিযোগ
-

নতুন এমপিওভুক্তি পেতে নীতিমালার কঠিন শর্তের আবর্তের মুখে পড়তে হবে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে। গত ১৪ মে জারি করা ‘জনবল কাঠামোর নীতিমালার’ শর্তগুলোকে ‘নতুন করে বাধা আরোপ’ বলে অভিহিত করেছেন আন্দোলনরত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃতির জন্য একমাত্র শর্ত হচ্ছে স্বীকৃতি। আর স্বীকৃতির জন্য ন্যূনতম ১৩ শর্ত। এ ১৩ শর্ত পূরণ করেই এক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃত পেয়েছিল ২০ বছর, ১৫ বছর ও ১৮ বছর আগে। এখন আবার নতুন করে কিসের শর্ত পূরণ করতে হবে? এখন ঈদের আগে শেষ কার্য দিবসে জনবল কাঠামো জারি করার উদ্দেশ্য মহৎ নয় মন্ত্রণালয়ের।
গোলাম মাহমুদুন্নবী আরো বলেন, আট বছর ধরে এমপিও বন্ধ রেখে এখন নতুন নতুন শর্তারোপ করা অমানবিক ও অযৌক্তিক। এর অর্থ হচ্ছে, শিক্ষক সমাজের সাথে সরকারের ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিমাতাসুলভ আচরণ। যেটি মোটেই কাম্য নয়। তিনি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কোনো রকম শর্তারোপ না করেই, স্বীকৃতিকালীন শর্ত পূরণকে বিবেচনায় নিয়ে এমপিওভুক্তির দাবি জানান।
গত ১৪ মে জারি করা ‘জনবল কাঠামো ও এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮’ অনুযায়ী এমপিওভুক্তি পেতে প্রথমে নতুন করে আবেদন করতে হবে। আবেদন কালেই নানা শর্তের বেড়াজাল অতিক্রম করেই আবেদন জমা দিতে হবে। শর্ত পূরণ না হলে আবেদন করার যোগ্যতা থাকবে না প্রতিষ্ঠানের। এর পরই জমাকৃত আবেদনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে এমপিও দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে। এ েেত্র আবেদনের শর্ত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সময়, শিার্থী সংখ্যা, পরীার্থী সংখ্যা ও পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে।
এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিও পেতে প্রধান চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১০০ নম্বর। এতে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির তারিখের জন্য রাখা হয়েছে ২৫ নম্বর। প্রতি দুই বছরের জন্য ৫ নম্বর এবং ১০ বা এর চেয়ে বেশি বছর হলে পাবে ২৫ নম্বর। শিার্থী সংখ্যার জন্য ২৫ নম্বর। আর শিার্থীর কাম্যসংখ্যা থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান পাবে ১৫ নম্বর এবং এর পরবর্তী ১০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য পাবে ৫ নম্বর। পরীার্থী ও উত্তীর্ণের সংখ্যায়ও শিার্থী সংখ্যার মতোই একইভাবে নম্বর বণ্টন করা হয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি পেতে কাম্য শর্তাদি অবশ্যই পূরণ করে যথাযথ কর্তৃপরে মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করতে হবে।
কাম্য যোগ্যতা পূরণ করতে নীতিমালা অনুযায়ী সহশিা ও বালক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নি¤œমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০ জন শিার্থী থাকতে হবে। মাধ্যমিকে শহরে ৩০০ ও মফস্বলে ২০০ শিার্থী থাকতে হবে। স্কুল অ্যান্ড কলেজে শহরে ৪৫০ ও মফস্বলে ৩২০ জন শিার্থী থাকতে হবে। উচ্চমাধ্যমিক কলেজে শহরে ২০০ ও মফস্বলে ১৫০ জন শিার্থী থাকতে হবে। স্নাতক পাস কলেজে শহরে ২৫০ ও মফস্বলে ২০০ শিার্থী থাকতে হবে। আর প্রতিটি শ্রেণীর পরীায় শহরে ৬০ ও মফস্বলে ৪০ জন শিার্থীর অংশ নিতে হবে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ শিার্থীকে উত্তীর্ণ হতে হবে।
নতুন ‘জনবল কাঠামো ও এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮’- উপরোক্ত পূরণ করতে গেলে বর্তমানে সারা দেশে এক শ’র বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। নতুন নীতিমালার শর্তপূরণ করতে গেলে আন্দোলনরত অনেক নন-এমপিও শিাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন করারই যোগ্যতাই নেই।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য ১৫ হাজার কোটি রাখা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে এমপিওভুক্ত শিকদের বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টে দিতে ৪০০ কোটি টাকা, বৈশাখী ভাতার জন্য ১৮৬ কোটি টাকা এবং নতুন শিা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করতে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। সরকার রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী বছরে শিকদের জন্য উপহার হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে এ তিনটি খাতের কথা অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেননি।
সারা দেশে এমপিদের চাপ এবং আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন শিাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির েেত্র নির্বাচনী আসন গুরুত্ব দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরে জাতীয় সংসদের আসন অনুযায়ী শিাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করা হবে। সে েেত্র সংসদীয় আসনপ্রতি তিনটি করে মোট ৯০০ শিাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হতে পারে বলে জানা গেছে। এর বাইরে বিশেষ ও অগ্রাধিকার ক্যাটাগরিতে আরো ১০০ শিাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি হবে।
এ দিকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আলাদা করে কোনো নির্দেশ না থাকায় নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা গত বাজেট উপস্থাপনের পরের দিন ৭ মে থেকে আবারো আন্দোলনে নামেন। শিক্ষকদের আন্দোলনের মধ্যেই গত ১৪ জুন ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করা হয়। শিা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন ঈদ-পরবর্তী প্রথম কর্মদিবসে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, একসাথে সব প্রতিষ্ঠান এমপিও করাও সম্ভব নয়। এ জন্যই শর্তসাপেে এমপিও দিতে এমপিও নীতিমালা-২০১৮ জারি করা হয়েছে। এমপিওভুক্তির আওতায় আসতে হলে নীতিমালার শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। নীতিমালা না করে কোনো কাজ করতে গেলেই নানামুখী চাপে পড়তে হয়। তিনি বলেন, নীতিমালার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাজেটে একসাথে এত চাপ সহ্য করা সম্ভবও নয়।
এমপিওর দাবিতে পুনরায় আন্দোলন শুরুর পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বেসরকারি শিাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। এ নিয়ে শিকদের আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বাজেটে অনেক বিষয়ে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। শিা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা থেকে এমপিওভুক্ত করা হবে অর্থমন্ত্রীর সাথে কথা বলে। এতে কোনো সমস্যা হবে না।
শিক্ষামন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী গত সপ্তাহে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আরো এক হাজার শিাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে এমপিওভুক্ত করা হবে। এ জন্য বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এমপিও একটি নিরর্থক কর্মসূচি। এটি শিকদের খুশি করার জন্য দেয়া হয়। স্কুলের ও শিক্ষার উপকার হয় না।
জানা যায়, বর্তমানে সরকার স্বীকৃত নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সংখ্যা পাঁচ হাজার ২৪২টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮০ হাজারের ওপর শিক-কর্মচারী চাকরি করছেন। দীর্ঘ দিন বিনা বেতনে চাকরি করছেন, এমপিও আশায়। এতে করে অনেকেরই চাকরির বয়সও শেষ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ নন-এমপিও শিাপ্রতিষ্ঠান শিক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্য গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানটি ১৮ থেকে ২০ বছর আগে স্বীকৃতি প্রাপ্ত। ২০০৬ সালে আমরা শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে অষ্টম স্থান লাভ করেছিলাম। আর এখন আমাদের দু’টি জিপিএ ৫ পেতেই কষ্ট হচ্ছে। তিনি বিপরীতে আরেকটি চিত্র তুলে ধরে বলেন, খুলনারই রূপসা মহিলা কলেজে ২০০৬ সালে শিার্থী ছিল না বললেই চলে। অথচ তারা এমপিও পাওয়ার পর এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আর্থিক সংস্থান না থাকলে প্রতিষ্ঠান চালানো খুবই কষ্টকর।
তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান তো অনেক আগেই এমপিও পাওয়ার কথা ছিল। আমাদের জন্য নতুন এই নীতিমালা কার্যকর করা কোনোভাবেই উচিত হবে না। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী এমপিও হলে এক শ’র বেশি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণ করতে পারবে না।
বৃষ্টি উপক্ষো করে প্রতীক অনশন
এ দিকে নন-এমপি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের চলমান শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে গতকাল তারা সারা দিন প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন। বৃষ্টির মধ্যেও অনশনে শিকেরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এখনো অনড়। তারা আগামীকাল (সোমবার) থেকে আমরণ অনশন শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার।
এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস কাবের সামনের রাস্তার উত্তর পাশে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেন। নন-এমপিওভুক্ত শিাপ্রতিষ্ঠান শিক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বিনয় ভূষণ রায় বলেন, গত কয়েক দিনে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার এবং তাদের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সব সংসদ সদস্যকে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
গতকাল দুপুরে বৃষ্টির মধ্যেও দেশের বিভিন্ন জেলার থেকে আসা শিক-কর্মচারীরা খোলা আকাশের নিচে অনশন করছেন। তারা বলছেন, এবার দাবি পূরণ ছাড়া তারা বাড়ি যাবেন না।


আরো সংবাদ



premium cement