২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এমপিও নীতিমালায় নানা শর্ত : ক্ষুব্ধ শিক্ষকেরা

নন-এমপিও শিক্ষকদের ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি :নয়া দিগন্ত -

বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণের লক্ষ্যে সরকার গত ১২ জুন একটি নীতিমালা জারি করেছে। তাতে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণের বিষয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা, পরীক্ষার ফলাফল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে এলাকায় অবস্থিত সেখানকার জনসংখ্যার পরিমাণ, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আরেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অনেক শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এসব শর্তকে শিক্ষকেরা শুধু কঠিন শর্ত নয়; বরং বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের ওপর স্টিমরোলার পরিচালনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন শিক্ষকেরা। তাদের মতে এতে করে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের জন্য এ নীতিমালা করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, এসব শর্তের কারণে বেসরকারি শিক্ষা খাত নিরুৎসাহিত হবে।
শিক্ষকদের দাবি আগের নীতিমালা অনুযায়ী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে হবে। শিক্ষকদের এ দাবি গত ৫ জানুয়ারি মেনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে পাশ কাটিয়ে নতুন নীতিমালা জারি করে শিক্ষকদের দাবি ও আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছে একটি মহল।
এমপিওকরণ নীতিমালা-২০১৮
এমপিওকরণ নীতিমালায় শহর ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া বালক ও বালিকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও আলাদা শর্ত রাখা হয়েছে।
শিক্ষার্থীবিষয়ক শর্তের মধ্যে রয়েছেÑশহরে নি¤œমাধ্যমিক বিদ্যালয় যদি সহশিক্ষা বা শুধু বালক হয় তবে ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। বালিকা হলে ১৮০। আর গ্রামে হলে যথাক্রমে ১৫০ ও ১২০ জন হতে হবে।
শহরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় যদি সহশিক্ষা বা শুধু বালক হয় তাহলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হতে হবে ৩০০ জন। আর শুধু বালিকা হলে ২০০ জন। একই প্রতিষ্ঠান গ্রামে হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হতে হবে যথাক্রমে ২০০ ও ১০০ জন করে।
শহরে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যদি সহশিক্ষা বা শুধু বালক হয় তাহলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে ৪৫০ জন এবং বালিকা হলে হবে ২০০ জন। আর একই প্রতিষ্ঠান গ্রামে হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে যথাক্রমে ৩২০ ও ১০০ জন করে।
শহরে উচ্চমাধ্যমিক কলেজ যদি সহশিক্ষা বা শুধু বালক হয় তাহলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে ২০০ জন। আর বালিকা হলে হবে ১৫০ জন। একই প্রতিষ্ঠান গ্রামে হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে যথাক্রমে ১৫০ ও ১২০ জন করে।
শহরে স্লাতক পর্যায়ের কলেজ যদি সহশিক্ষা বা শুধু বালক হয় তাহলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে ২৫০ জন। আর বালিকা হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে ২০০ জন। গ্রামের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা হবে যথাক্রমে ২০০ ও ১৫০ জন করে।
পরীক্ষার ফলাফল বিষয়ক শর্তের মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় শহরে হলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হতে হবে কমপক্ষে ৬০ জন। পাসের হার হতে হবে শতকরা ৭০ ভাগ। আর গ্রামে এ হার যথাক্রমে ৪০ ও ৭০ ভাগ।
উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের ক্ষেত্রেই একই শর্ত রাখা হয়েছে এমপিও পাওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে।
এ ছাড়া প্রতিটি ক্যাটাগরির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষক কর্মচারী বিষয়ে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নি¤œমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৮ জন, মাধ্যমিকে ২২ জন, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) ৩০ জন, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ১৭ জন এবং স্নাতক (পাস) পর্যায়ের কলেজে ২৮ জন শিক্ষক কর্মচারী থাকতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে তার বিপরীতে নম্বর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন শর্তকে মোট চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্রতি ক্যাটাগরিতে ২৫ নম্বর করে মোট ১০০ নম্বর রাখা হয়েছে। এগুলো হলো একাডেমিক স্বীকৃতির ওপর ২৫ (প্রতি ২ বছরের জন্য ৫ নম্বর। ১০ বা এর বেশি হলে ২৫), শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ এবং উত্তীর্ণ হার ২৫। বাকি তিনটি ক্যাটাগরিরর জন্য কাম্য সংখ্যা পূর্ণ হলে ১৫ নম্বর এবং পরবর্তী ১০ জন শিক্ষার্থী থাকলে ৫ নম্বর করে যোগ হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণ বিষয়ে ভৌগোলিক দূরত্ব ও এলাকার জনসংখ্যা বিষয়ক বেশকিছু শর্ত রাখা হয়েছে। নি¤œ মাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রে শহরে এক কিলোমিটার, গ্রামে তিন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত হতে হবে। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে শহরে এক কিলোমিটার ও গ্রামে চার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত হতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে শহরে দুই কিলোমিটার ও গ্রামে ছয় কিলোমিটারের মধ্যে হতে হবে।
এ ছাড়া নি¤œ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতির ক্ষেত্রে স্কুল এলাকায় ১০ হাজার জনসংখ্যা থাকতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে থাকতে হবে ৭৫ হাজার জনসংখ্যা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ের বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমিপওকরণের জন্য এ নীতিমালা জারি করা হয়েছে।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার নীতিমালা বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যার কোনটার বয়স ১৮ বছর, কোনটার বয়স ২০ বছর। অনেক আগেই এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওকরণের যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু দীর্ঘকাল এমপিওকরণ না হওয়া, সরকারের কোনো আর্থিক সুবিধা না পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান পরে আর আগের মতো ছাত্রছাত্রী, সুনাম ধরে রাখতে পারেনি। অথচ সরকার যদি এসব প্রতিষ্ঠানকে সময় মতো এমপিওকরণ করত তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান এখন অনেক এগিয়ে যেতে পারত, অনেক ভালো করতে পারত। কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণের সব যোগ্যতা অর্জন ও শর্ত পূরণ করলেও সরকারের অবহেলা এবং উদাসীনতার কারণে সময় মতো এমপিওকরণ না করায় এসব অনেক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকে ধুঁকে কোনো মতে টিকে আছে। এখন যদি সরকার নতুন নীতিমালা জারি করে এবং কঠিন শর্ত দিয়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এত বছর পর এমপিওর বাইরে রেখে দেয়, তা হবে খুবই অমানবিক। যারা বিনা বেতনে বছরের পর বছর আশায় আশায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রেখেছেন তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। আমরা চাই পুরনো নীতিমালার আলোকে এবং সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানকে আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হোক। আমরা মনে করি নতুন যে নীতিমালা জারি করা হয়েছে তা আমাদের প্রতি স্টিমরোলার চালানোর শামিল।
ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ড. বিনয়ভূষণ রায় নয়া দিগন্তকে বলেন, এমপিওকরণ বিষয়ে নতুন যে নীতিমালা জারি করা হয়েছে এটা আমানবিক। এটা একটা চক্রান্ত। শিক্ষক সমাজ এ নীতিমালা মানতে পারছে না। কোনো একটি শ্রেণীর শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য এটা করা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা খাত নিরুৎসাহিত হবে এ নীতিমালায়। অথচ দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৬ ভাগই বেসরকারি খাতে।
নীতিমালায় শিক্ষার্থীর শর্ত বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিকমতো শিক্ষার্থী পায় না। মানসম্মত শিক্ষার্থী পায় না। এ নীতিমালার মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার দাবিতে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন। ৩১ ডিসেম্বর থেকে তারা আমরণ অনশন শুরু করেন। ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ সাজ্জাদুল হাসান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনরত শিক্ষকদের মধ্যে এসে দাবি মেনে নেয়ার কথা জানান শিক্ষকদের। সাজ্জাদুল হাসান বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে জানাতে বলেছেন তিনি আপনাদের দাবি মেনে নিয়েছেন। তিনি আপনাদের অনশন ভেঙে যার যার বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন।
কিন্তু গত ৭ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত জাতীয় বাজেটে শিক্ষকদের এমপিওকরণ, জাতীয়করণের বিভিন্ন দাবি মানা এবং বরাদ্দ বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ না থাকায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষকেরা।
গত ১০ জুন থেকে তারা আবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছেন। আগামী সোমবার থেকে তারা আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমিপওভুক্তির দাবিতে ২০০৬ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষকেরা। রাজধানীসহ সারা দেশে তারা বারবার আমরণ অনশন, লাগাতার অবস্থান, বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। রাজধানীতে ২০১৩ সালে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে পুলিশের বিষাক্ত পিপার স্প্রের ঘটনায় আহত হয়ে ১৪ জানুয়ারি মারা যান শিক্ষক মোহাম্মদ সেকেন্দার আলী (৪৫)। তিনি পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার চরবয়রা মডেল বালিকা দাখিল মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন। ফেডারেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পাঁচ হাজার ২৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা সম্পূর্ণ নন-এমপিও।

 


আরো সংবাদ



premium cement