২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশের প্রথম সিটিগোল্ড তৈরি কারখানার গল্প

ঝিনাইদহের মহেশপুরে সিটিগোল্ড তৈরির একটি কারখানা - নয়া দিগন্ত

ঝিনাইদহের মহেশপুর ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা। যার আয়তন ৪১৬ বর্গকিলোমিটার। ২০৬ টি গ্রামে বসবাস করেন ৩ লাখ ৩২ হাজার ৫১৪ জন। উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার বেশিরভাগই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রেখা রয়েছে। উত্তরে কোটচাঁদপুর ও জীবননগর উপজেলা ও পূর্বে যশোরের চৌগাছা উপজেলা রয়েছে। মহেশপুর উপজেলা শহরটি অনেক পুরনো। ১৮৬৯ সালে এখানে পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। যে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন পিবি মার্টিন নামের এক ইংরেজ । এছাড়াও এখানে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বীদের ১৯টি পাঠের মধ্যে একটি পাঠ। এ শহরে ছিল বেশ কয়েকটি স্বর্ণের দোকান। যার মধ্যে দুই ভাই আব্দুর রহিম আর আব্দুল হামিদের ছিল একটি। নাম ছিল মুসলিম জুয়েলার্স। এই দুই ভাইয়ের একজন আব্দুর রহিম বাংলাদেশের প্রথম সিটি গোল্ড তৈরির কারিগর বলে জানান শহরের স্বর্ণকার ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। তিনি ইতিমধ্যে মারা গেছেন। এখন তার সন্তান ও ২ ভাই বিভিন্ন নাম দিয়ে সিটি গোল্ড প্রতিষ্ঠা করে ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা জানান, পুলিশ প্রশাসন সহ অনেক ঝক্কি ঝামেলা রয়েছে, তার পরও হাজার হাজার শ্রমিকের কথা চিন্তা করে লাভ না থাকলেও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
মনি সিটি গোল্ডের মালিক আব্দুল হামিদ জানান, তাদের বাড়ী পৌরসভার বোঁচিতলা গ্রামে। তারা ৪ ভাই একসাথেই ছিলেন। তাদের বড় ভাই আব্দুর রহিম মুসলিম জুয়েলার্স নামে শহরে একটি স্বর্ণের দোকান দেন। এরশাদ সরকারের শেষ সময়ে ৯০/৯১ সালের দিকে হঠাৎ করে সোনার দাম বেড়ে যায়। ৫ হাজার টাকা ভরি সোনা মাত্র দুই বছরে ১৬ হাজার টাকায় দাড়ায়। এই সোনার মুল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের জুয়েলারি দোকানে খরির্দ্দার কমে যায়। ব্যবসা বন্ধ হতে চলেছিল। ঠিক সেই সময় তার বড় ভাই আব্দুর রহিম নিজের মেধা দিয়ে শুরু করেন সিটি গোল্ডের ব্যবসা।
তিনি আরো জানান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কিছু এলাকায় সিটি গোল্ডের প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই বড় ভাই আব্দুর রহিম এই অলংকারের ধারণা নিয়ে আসেন। ২০০৩ সালে প্রথমে শহরে একটি ভাড়া ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন কারখানা। যার নাম দেন মিলন সিটি গোল্ড।
আব্দুর রহিমের আরেক ভাই আব্দুল হাই জানান, মাত্র ৬ মাসে এই অলংকারের এতোটা চাহিদা চলে আসে যে তারা সরবরাহ করে উঠতে পারছিলেন না। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের কারখানায় উৎপাদনও বেড়ে যায়। কারখানার আয়তনও বৃদ্ধি পায়। কারখানার শ্রমিকও অল্পদিনের মধ্যে শতজন ছাড়িয়ে যায়। প্রথম দিকে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ শত জোড়া কানের দুল তৈরি করতেন। বর্তমানে তারা প্রতিদিন ৫ হাজার জোড়া দুল তৈরি করছেন। এভাবেই চলছে তাদের ব্যবসা।
সরেজমিনে মহেশপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বেশ কিছু গ্রামের বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে এই অলংকার। উপজেলার নওদাপাড়া, জলিলপুর, রামচন্দ্রপুর, বামনগাছি, মির্জাপুর, সেজিয়া, যাদবপুর, মহেশপুর পৌর এলাকা সহ আরো বেশ কিছু গ্রামে এই অলংকার তৈরি হচ্ছে।
মির্জাপুর গ্রামের আবুল কাশেম জানান, তাদের এলাকার কেউ এখন আর বেকার নন। পরিবারের সবাই মিলে এই কাজ করেন। নিজেদের বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারছেন। তিনি জানান, অনেকে আছেন যারা বাজার থেকে ব্রঞ্চ কিনে তৈরি করেন। এরপর মহাজনের ঘরে বিক্রি করেন।
গাড়াবাড়ীয়া গ্রামের তৌহিদুল ইসলাম জানান, তিনি প্রথম থেকেই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। ১৫ বছর এই পেশায় আছেন। হাজার হাজার অলংকার তৈরি করেছেন এবং তিনি ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন শহরে এগুলো পাইকরি হিসাবে বিক্রি করে আসেন। নিজের ৫ সদস্যের সংসার চালিয়ে মাঠে কিছু জমিও কিনেছেন।
বজলুর রহমান নামের একজন জানান, তিনি এই সিটি গোল্ডের গয়না দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাজারজাত করেন। সিটি গোল্ডের গয়না নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ভারতীয় মাল বলে আটক করে। কাগজপত্র দেখালেও তারা মানতে চান না। পরে নগদ নারায়নে তুষ্ঠ করলেই ছেড়ে দেয়।
শহরের রনি সিটি গোল্ডের মালিক আব্দুল হাই জানান, তারা কারখানায় এগুলো তৈরি করে পাইকারীর পাশাপাশি দোকানে খুচরা বিক্রি করেন। তার ভাষায়, একজোড়া কানের দুল তৈরি করতে ৭ থেকে ৮ টাকা খরচ হয়। এগুলো পাইকারি ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। পরবর্তীতে হাতবদল হয়ে বিভিন্ন শহরে চলে যায়। দোকানগুলোতে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গলার চেইন ৩০ থেকে ৪০ টাকা, এক জোড়া বালা ৬ শ’ টাকায় বিক্রি করছেন তারা। তবে এখন বালা তৈরিতে খরচ বেশি, দাম অনেক কম। তাই বালা বানান না তারা। নকশার কারণে মুল্য কমবেশি হয়ে থাকে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
আরেক ব্যবসায়ী কবির হোসেন জানান, মহেশপুর এলাকায় তৈরি এই সিটি গোল্ড দেশের সব শহরেই পাওয়া যাবে। মহেশপুর শহরে বর্তমানে রং এর ১৭ টি কারখানা রয়েছে। একটি কারখানায় প্রতিদিন ৫ হাজার কানের দুল রং করা সম্ভব। আর গোটা উপজেলায় ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ নিয়মিত কাজ করছেন।
আব্দুল হামিদ জানান, বাড়ি বাড়ি তৈরি হওয়ায় তাদের লাভের পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। তবে অনেকেই কাজ করছেন, যা মানুষের বেকারত্ব দুর হয়েছে।
তবে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন মহেশপুরেই ১৭টির মত কারখানা রয়েছে আমাদের ব্যাবসায় লাভ খুব সীমিত তার পরও প্রশাসন ও মাহাজনরা এভাবে চলতে থাকলে এদেশ থেকে সিটি গোল্ড বন্ধ হয়ে যাবে। তখন হাজার হাজার শ্রমিক আবার বেকার হয়ে কি করে পেটের জ্বালা মিটাবে তারা বুঝবে ?

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল