২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জারবেরা যেভাবে পাল্টে দিলো ফুলের রাজ্য

জারবেরা যেভাবে পাল্টে দিলো ফুলের রাজ্য - ছবি : নয়া দিগন্ত

যশোর রোড। আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে যশোর রোডের রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সবুজের বুক চিরে বেনাপোল অভিমুখে এগিয়ে চলেছে সড়কটি। দু’পাশে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন গাছগুলো। যশোর শহর থেকে এ সড়ক ধরে শতবর্ষী বৃক্ষের ছায়া মাড়িয়ে বেনাপোলের দিকে ১৮ কিলোমিটার গেলেই গদখালী বাজার। আশি হাজার গ্রামের ভিতর দক্ষিণে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন একটি গ্রামের নাম গদখালী। অজপাড়াগাঁয়ের এই গদখালীকে দেশবাসীকে অন্যভাবে চিনিয়েছে এখানকার কৃষকরা। এক সময় এখানকার কৃষকদের নুন আনতে পান্তা ফুরাত। সবাই ব্যস্ত থাকতো ধান-পাট শাক-সবজি চাষে। কেউ কেউ চোরাচালানির মাল এপার-ওপার করত। সেই দুর্দিন এখন ইতিহাস। মাত্র তিন দশকে বদলে গেছে দৃশ্যপট। ফুলের সৌরভে গদখালীকে চেনে গোটা বাংলাদেশ। পেয়েছে ফুলের রাজধানী খ্যাতি। এ জনপদটি নাম একাকার হয়ে গেছে ফুলের সাথে। ফুল চাষ ও কেনাবেচার সাথে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে এই এলাকার মানুষ। অনেকেই হয়েছেন কোটিপতি।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় গদখালীর অবস্থান। গদখালী একটি ইউনিয়ন। ঝিকরগাছা বাজার ছাড়িয়ে গদখালী বাজার। প্রতিদিন প্রভাতে বসে ফুলে বাজার। এ বাজারে কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় ফুল বেচা কেনা। যশোর থেকে বেনাপোল রুটের বাসে সরাসরি গদখালী যাওয়া যায়। গদখালী থেকে পূর্বদিকে দুই কিলোমিটার পথ গেলেই ফুল সাম্রাজ্য শুরু। ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নভারণ, হাজিরবাগ ,নির্বাসখোলা, বাকড়া,শংকরপুর, উলশী ইউনিয়নের হাড়িয়া,কৃষ্ণচন্দ্রপুর,পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া, মাটিকুমড়া, বাইসা, কাউরা, ফুলিয়াসহ প্রতিটি গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রথস্টিক, জিপসি, গ্যালেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানা রঙের ফুল। চোখ ধাঁধানো এই সৌন্দর্য কেবল মানুসের হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তিই আনে না, ফুল চাষ সমৃদ্ধিও এনেছে অনেকের জীবনে। ফুলেল স্নিগ্ধতায় এখন ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের। বিভিন্ন দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে মুখিয়ে আছেন দেশের কোটি তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সীরা। প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে ফুলই শ্রেষ্ঠ। মানুষের মনের খোরাক মেটাতে এখন দিনরাত পরিশ্রম করছেন যশোরের গদখালীর ফুলচাষীরা।
১৯৮৩ সালে ছোট্ট একটি নার্সারি থেকে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু করেন শের আলী। এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষের পথিকৃৎ তিনিই।

কৃষক হয়েও গেছেন কোটিপতি বনে। ঘুরেছেন বিশ্বের ১৮টি দেশ। গত তিন দশকে পুরো ঝিকরগাছা উপজেলায় এক শের আলীর পরিবার থেকে তৈরি হয়েছে সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি শের আলী। ১৫ থেকে ২০ লক্ষ্য লোক ফুল চাষের সাথে জড়িত।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে এ জেলায় ৬৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। তারা উৎপাদন করছেন মন মাতানো দেশি-বিদেশি ফুল। রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রথস্টিক, জিপসি, গ্যালেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকার ।

মাঠের পর মাঠ। যে দিকে চোখ যা শুধু ফুল আর ফুর। চাষ হয় সারা বছর। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন, পয়লা বসন্ত, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে। সারা বছরের তুলনায় এ কয়টি দিবসে ফুল বিক্রি হয় কয়েকগুণ বেশি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য মতে, এবার যশোরে ৬০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যশোরে প্রায় ৭ হাজার ফুল চাষী পরিবার বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষের সাথে সস্পৃক্ত। তার ভিতর সবচেয়ে বেশি চাষ হয় গ্যালোরিয়াস শতকরা ৪০% চাষ করে এখানকার ফুল চাষীরা। তারপরই ২০% চাষ হয় রজনীগন্ধা। গোলাপ ১৫% চাষ হয়। তাদের উৎপাদিত জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল ফুল সারাদেশের মানুষের মন রাঙাচ্ছে।
কৃষক সোহেল রানা বলেন, সারা বছর ফুল উৎপাদন ও বিক্রি হলেও এখানকার চাষিরা বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এ দিনগুলোতেই তারা সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি করতে পারেন এবং দামও ভালো পান।

তিনি বলেন, তাদের উৎপাদিত ফুল গদখালী বাজার থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় ৫২টি জেলায় যায়। ওইসব জায়গা থেকে ফুল ব্যবসায়ীরা গদখালী বাজারে এসে ফুল কিনে নিয়ে যান।
তরুণ ফুল চাষী দিলদার হোসেন জানান, ফুল চাষে আসা বংশপরম্পরায়। আমার বাবা ফুল চাষ করতো। এখন আমিও ফুল চাষের সাথে সম্পৃক্ত।

এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষের পথিকৃৎ শের আলী বলেন, ফুলচাষিরা ক্রমেই দক্ষ হয়ে উঠছেন। তারা আন্তর্জাতিকমানের ফুল উৎপাদন করছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে দিন দিন এ চাষ বাড়ছে। ফুল রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। চাষিরাও ফুলের ভালো দাম পাচ্ছেন ভাল।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, যশোর জেলায় ১৯৮৩ সালে গদখালীতে মাত্র ৩০ শতক জমিতে ফুল চাষ শুরু হয়। এখন চাষ হচ্ছে হেক্টর হেক্টও জমিতে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার ৭০ ভাগই যশোরের চাষীরা সরবরাহ করছে। দেশের গ-ি পেরিয়ে এই ফুল এখন যাচ্ছে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াতেও। এ মাসের তিন দিবাসে প্রায় ৬০ কোটি ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

যশোরের অঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক এমদাদ হোসেন জানান, এবার জেলায় ৬৩২ হেক্টর জমিতে ছয় হাজার চাষি নানা প্রকার ফুল চাষ করেছেন। ফুল চাষ ও কেনাবেচার সাথে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে এই এলাকার মানুষ।

নান্দনিক ফুল জারবেরা
লাল, সাদা, হলুদ, পিংক, ম্যাজেন্টা, কমলা রঙের জারবেরা ফুল। সূর্যমুখী পরিবারের জনপ্রিয় ফুলটির নাম জারবেরা। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াসের বন্ধু জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও প্রকৃতিবিদ ট্রাউগট গেরবার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। সাধারণত ফুলটি আফ্রিকান ডেইজি নামেও পরিচিত। প্রায় ৩০টি প্রজাতির জারবেরা ছড়িয়ে আছে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায়।
সূর্যমুখীর মতো দেখতে এই ফুলগাছের পাতা পালং শাকের মতো। দেশে লাল, সাদা, হলুদ, গোলাপি, কমলাসহ কয়েকটি রঙের জারবেরার চাষ হয়। সারা বছরই জারবেরা ফুল ফোটে।

যশোরের গদখালীতে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে চাষ হচ্ছে জারবেরা। এ অঞ্চলে ফুলচাষের পথিকৃৎ শের আলী প্রথম জারবেরা ফুলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেন। তিনি জানান, জারবেরা ফুলের চাহিদা ব্যাপক। জারবেরা ফুলের নান্দনিক সৌন্দর্য ফুলের জগতে ২০০৯ সালে এক আলাদা মাত্রা যোগ করেন । সাধারণত জারবেরা ফুল গাছ থেকে তোলার ৮-১৫ দিন এবং গাছে ফোটা অবস্থায় ৩০ থেকে ৪৫ দিন সতেজ থাকে। জারবেরা ফুলের বীজ থেকে চারা হয় না। সাকার উৎপাদনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। একবার চারা রোপণ করলে বহু বছর ফুল পাওয়া যায়।

 

বাণিজ্যিক ফুল চাষের মডেল যশোরের শের আলী

ঝিকরগাছা উপজেলার নিভৃত পল্লীর পানিসারা গ্রামের বাসিন্দা নার্সারী ব্যবসায়ী মরহুম আব্দুর রহমান সরদারের ছেলে শের আলী। ১৯৫০ সালে তিনি জম্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাধারণ কৃষক। আর ১০ জন সাধারণ কৃষকের মতোই ছিল তার জীবনযাত্রা।

শের আলী বলেন, তার বাবা মরহুম আব্দুর রহমান সরদারের একটি ফলজ ও বনজ নার্সারি ছিল। যশোর- বেনাপোল সড়কের রজনীগন্ধা ফিলিং স্টেশনের ধারে অবস্থিত ওই নার্সারির নাম ছিল সরদার নার্সারি। এ নার্সারিতে উৎপাদিত বিভিন্ন গাছের চারা বিক্রি করেই চলতো শের আলীর পরিবার। ১৯৮২ সালে ভারত থেকে দেশে ফিরছিলেন নূর ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তার হাতে বেশ কিছু রজনীগন্ধা ফুলের স্টিক ছিল। পথিমধ্যে নূর ইসলাম পানি পানের উদ্দেশে সরদার নার্সারির সামনে নামেন। ওই সময় শের আলীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এর কয়েক মাস পর নূর ইসলামের মাধ্যমে ভারত থেকে রজনীগন্ধা ফুলের বীজ আনেন শের আলী।

এ সময়ে ধান, পাট বা রবিশস্যের পরিবর্তে ৩০ শতক জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষের এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন তিনি। যা এলাকার কৃষকের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। শের আলী হয়ে ওঠেন সফলতার এক উজ্জ্বল নজির। ১৯৮৩ সালে প্রথম ফুল ধরতে শুরু হয়। যশোরের গদখালীতে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে চাষ হচ্ছে জারবেরা। এ অঞ্চলে ফুলচাষের পথিকৃৎ শের আলী প্রথম জারবেরা ফুলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তিন বিঘা জমিতে শের আলীর বিভিন্ন জাতের ফুল রয়েছে। নিজে ফুলচাষের বিস্তার ঘটিয়ে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে বীজ বিতরণ করে ফুলচাষে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। এভাবে পর্যায়ক্রমে পানিসারাসহ আশপাশের এলাকায় শুরু হয় ফুলের চাষ। ১৯৮৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু করেন শের আলী।

এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষের পথিকৃৎ তিনিই। কৃষক হয়েও গেছেন কোটিপতি বনে। ঘুরেছেন বিশ্বের ১৮টি দেশ। গত তিন দশকে পুরো ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলায় এক শের আলীর পরিবার থেকে তৈরি হয়েছে সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি শের আলী। ১৫ থেকে ২০ লক্ষ্য লোক ফুল চাষের সাথে জড়িত। শের আলী শুধু নিজ থানা বা জেলা নয়, সারা বাংলাদেশে একজন ফুল মডেলে পরিণত হলেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement