১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পথশিশু ও শরিয়তের নির্দেশনা-৩

-

আলোচ্য পথশিশু সংক্রান্ত বিধান কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। যেমন :
এক. তেমন পথশিশু যদি এমন অবস্থান বা পরিবেশে হয়ে থাকে যে, তাকে তাৎক্ষণিক কুড়িয়ে না নিলে, মারা যাবে বা পশুপ্রাণীর খোরাক হয়ে ধ্বংসের মুখে চলে যাবে; অথচ সেখানে অন্য আর কেউ নেই; সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষকারী বা অবহিত ব্যক্তির জন্য তাকে কুড়িয়ে নেয়া এবং হিফাজতের ব্যবস্থাকরণ ফরজ। আর যদি সেখানে অন্য কেউ বা একাধিক লোকজন বিদ্যমান হয়; তা হলে সে ক্ষেত্রে তার জন্য শিশুটিকে উদ্ধার করা এবং লালন-পালনের ব্যবস্থাকরণ ‘ফরজে কিফায়া’। আর যদি এমন হয় যে, শিশুটি তেমন ধ্বংসের মুখোমুখি নয় এবং সেখানে তার দায়িত্ব গ্রহণের মতো লোকজন আরো অনেকেই থাকে; সে ক্ষেত্রে তাকে কুড়িয়ে নেয়া এবং তার দায়িত্ব গ্রহণ ‘মুস্তাহাব’। যেমন আল্লামা যয়নুদ্দীন ইবনু নুজাইম রহ: ‘কানযুদ-দাকায়েক’ সূত্রে ‘যাহিরুর-রিওয়ায়েত’ উদ্ধৃত করে,এর ব্যাখ্যায় বলছেনÑ
“তেমন পথশিশুকে কুড়িয়ে নেয়া, ‘মুস্তাহাব’; কিন্তু যদি শিশুটি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, তা হলে ‘ওয়াজিব’।” এর আইনগত ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনু নুজাইম বলছেন, ‘মুস্তাহাব’ এ হিসেবে যে, তা একটা ভালো ও উত্তম কাজ।
‘ওয়াজিব’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলছেন, “অর্থাৎ ‘ফরজে কিফায়া’ সে ক্ষেত্রে যদি তাকে কুড়িয়ে না নিলে, তার প্রবল ধারণা মতে, শিশুটি মারা যাবে বা ধ্বংসের মুখে পতিত হবে... যেমন কি না কেউ দেখতে পাচ্ছে, একজন অন্ধ গর্তে বা কূপে পড়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তার জন্য তাকে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করা ফরজ হয়ে থাকে (অর্থাৎ এটা পারিভাষিক ‘ওয়াজিব’ বলতে যা বোঝানো হয়, তা নয় বরং ফরজ দায়িত্ব)। আর ‘কিফায়া’ হয় এই বিবেচনায় যে, তা যেকোনো একজনে করলে, শিশুটি রক্ষা পেয়ে যাবে। আর যে ক্ষেত্রে অন্য কেউ উপস্থিত নেই বা জানে না, সে ক্ষেত্রে তার জন্য দায়িত্বটি পালন করা নির্দিষ্ট তথা নির্ধারিতভাবে ফরজ হয়ে যায়।... (অতঃপর বলছেন:) আমরা পারিভাষিক অর্থে ওয়াজিব বলতে যা বুঝি, এখানে ওয়াজিবের সেই অর্থ নয়; বরং তা ফরজ; তাই, বিষয়টি প্রশ্নে আমাদের ও অন্যান্য গবেষক ইমামগণের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; যেমন কারো কখনো কখনো তেমন সংশয় হতে পারে। আর কুড়িয়ে বা তুলে নেয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে, তাকে পুনরায় সেখানে রেখে আসা বা ফেলে দেয়া, আইনি বিবেচনায় হারাম বলে গণ্য হওয়া জরুরি। কেননা সে উঠিয়ে নেয়ার দ্বারা তার জন্য, তার হিফাজত যেখানে ফরজ হয়ে গেল, সেখানে তাকে পুনরায় যেখানে পেয়েছে সেখানে রেখে আসার অধিকার থাকতে পারে না।” (আল-বাহরুর রায়িক : খ-৫, পৃ-২৪১, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ.পি, ভারত, সংস্করণ-১৯৯৮খ্রি.)
দুই. আরেকটি বিধান হলো, শিশুটিকে নিজ দায়িত্বে রেখে দেয়া, তার লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করা প্রশ্নে, যিনি তাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন, অগ্রাধিকার তারই থাকবে। অন্য কেউ ইচ্ছে করলেই শিশুটিকে তার কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারবে না; তবে হ্যাঁ, তিনি অপারগ হলে অথবা সম্মত হয়ে অন্যকে প্রদান করলে, ভিন্ন কথা। তার কারণ তিনিই কুড়িয়ে নেয়ার মাধ্যমে শিশুটির জীবন রক্ষা করেছেন। প্রিয়নবী সা: ইরশাদ করেছেনÑ
“যে ব্যক্তি কোনো মৃত (প্রায়) ভূমি (সেচ ও চাষ-বাসের দ্বারা) জীবিত করে বা করবে, সেই তার মালিক হবে; মহানবী সা-:এর ভাষ্যানুযায়ী।”
আর এ ছাড়া এ কারণে যে, তা এমন একটা সাধারণ ও ব্যাপক সমান অধিকারকেন্দ্রিক বিষয়, যা যিনি আগে করেন, ধরেন, নিয়ে নেন; তাতে তাঁর অধিকার প্রাধান্য পায়। যেমন গণরাস্তায় হাঁটা, মসজিদে আগে গিয়ে স্থান দখল করা, মিনা-আরাফায় যিনি আগে যেখানে স্থান গ্রহণ করেন; সেখানে তাঁরই অগ্রাধিকার বা প্রাধান্য বর্তায়। (রাদ্দুল-মুহতার : খ-২, পৃ-৪৩৬; যাকারিয়া বুক ডিপো, ই.পি, ভারত; সংস্করণ-১৯৯৬খ্রি.)
‘নেয়া’ ‘দখল’ বা ‘গ্রহণ করা’ বিষয়ক ‘মুবাহ’ ও বৈধ কাজের অন্যতম, যা কুড়িয়ে নেয়া-লোকটি সর্বাগ্রে করতে সক্ষম হয়েছে। আর নবীজী সা:-এর ভাষ্য মতে, কোনো মুবাহ বিষয়ে সবার আগে যে তা করবে, তাতে তারই অগ্রাধিকার থাকবে বা গণ্য হবে।” (বাদায়েউস-সানায়ে‘ : খ-৫, পৃ-২৯২, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ.পি, ভারত, সংস্করণ-১৯৯৮খ্রি.)
তিন. আরেকটি বিধান হলো, তেমন পথশিশুর ভরণপোষণ ও ব্যয়ভারের দায়িত্ব বর্তাবে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর। কেননা তার যদি কোনো সম্পদ থাকে, তা-ও তার অবর্তমানে রাষ্ট্রেরই পাওনা বা মালিকানা বলে ধর্তব্য হয়ে থাকে।
আর যদি পতিত শিশুটির সাথে কোনো মাল-সম্পদ পাওয়া যায়, তা তারই বলে গণ্য হবে। কেননা বাহ্যিক অবস্থা দ্বারা বোঝা যায়, তা তারই সম্পদ; সুতরাং তারই বলে ধর্তব্য হবে; যেমন কি না তার পরিহিত, তার সাথে সংযুক্ত কাপড়-চোপড়ও তারই হয়ে থাকে। একইভাবে শিশুটিকে যদি কোনো বাহন-জন্তুর ওপর বাঁধা বা রাখা অবস্থায় পাওয়া যায়, তার মালিকানাও তারই বলে গণ্য হবে; যার কারণ আমরা বলেছি। আর সে ক্ষেত্রে অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে শিশুটির মাল-সম্পদ থাকবে, তার ব্যয়ভার তার নিজ সম্পদ দ্বারাই বহন করা হবে। তার কারণ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বহনের বিষয়টি হলো, ঠেকা ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে; আর যেখানে তার নিজস্ব সম্পদ থাকে, সেই ঠেকা অনুপস্থিত। আর কুড়িয়ে নেয়া ব্যক্তির জন্যও, আবশ্যকীয় কারণ না থাকায়, তেমন অবস্থায় শিশুটির ব্যয়বহনে খরচ করা আইনত জরুরি নয়। যদি সে নিজ সম্পদ থেকে তার খরচ বহন করে, সে ক্ষেত্রে তা যদি বিচারকের অনুমতি নিয়ে করে থাকে, তা হলে শিশুটির মাল থেকে তা নিয়ে নিতে পারবে; আর যদি অনুমতি ছাড়া ব্যয় করে থাকে, তা হলে তার সম্পদ হতে নিয়ে নিতে পারবে না; তা তার পক্ষ হতে নফলদান ও নৈতিক দায়িত্ব পালন, বলে গণ্য হবে।” (প্রাগুক্ত: পৃ-২৯৩)
(চার). আরেকটি বিধান হলো, “তার রক্তপণের মালিক হবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। কেননা সে কোনো অর্থদণ্ডের কাজ, রক্তপণ আদায়ের মতো অপরাধ করলে, তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়; তাই তার সূত্রে প্রাপ্ত রক্তপণ বা সম্পদও সরকারি তহবিলে যাবে।” (প্রাগুক্ত)
(পাঁচ). “সে যখন সাবালক হবে, তার যাকে ইচ্ছা মনিব বা অভিভাবকরূপে গ্রহণ করতে পারবে। তবে যে ক্ষেত্রে তার কোনো অপরাধজনিত কারণে রাষ্ট্র তার পক্ষে, তার হয়ে, রক্তপণ পরিশোধ করবে, সে ক্ষেত্রে সে অন্য কাউকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করতে পারবে না। অবশ্য প্রশাসনের অনুমোদনক্রমে হলে ভিন্ন কথা।
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন


আরো সংবাদ



premium cement