২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলামে দেশপ্রেম

-

স্বাধীনতা একটি ব্যাপক প্রত্যয়। স্বাধীনতা মানুষের অস্তিত্বে লালিত সুপ্ত প্রতিভা ও শক্তিকে ক্রমাগত উন্নতি অগ্রগতি-সমৃদ্ধির পথে বিকশিত করতে সাহায্য করে। মানুষ স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চায়, চায় স্বাধীনভাবে মনোভাব প্রকাশ করতে। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার যা বড় এক নেয়ামত। হাদিসে বর্ণিতÑ প্রত্যেক মানব সন্তান ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে (মিশকাত)। ফিতরাত বা প্রকৃতির মধ্যেই স্বাধীনতার মর্মবাণী নিহিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খড়গহস্ত প্রসারের মাধ্যমে এ স্বাধীনতা প্রক্রিয়া যখন ব্যাহত হওয়ার উপক্রম, তখন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অথবা টিকিয়ে রাখতে যুগে যুগে দেশে দেশে বিভিন্ন জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। পরাধীনতার শিকল মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র আবাসন নির্মাণের প্রয়াস পায়। মানুষ জীবন বাজি রেখে স্বদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কাজে রত থাকে, তাদের এ নৈতিক অধিকারকে ইসলাম সমর্থন করে। ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’ মর্মবাণী অনুধাবন করে স্বদেশপ্রীতির প্রেরণায় মানুষ যুগে যুগে কত স্বার্থ ত্যাগ স্বীকার করেছে, যার হিসাব জানা মুশকিল। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন বিলিয়ে দিতে পরোয়া করে না, বরং দেশ ও জাতির সেবায় আত্মোৎসর্গ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে।
দেশপ্রেমের উদারতা ইতিহাসে ব্যাপক, মুসলামনরা রাসূল সা: -এর দিকনির্দেশনায় পুণ্য লাভের আশায় পরিখা খননের কাজে ব্যাপকভাবে অংশ নেন। কুরাইশ বাহিনী যাতে পরিখা পার হয়ে মদিনায় আসতে না পারে, কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর ব্যর্থ মনে মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হয় কুরাইশ বাহিনী। সে সময়ে সেটা স্বাধীনতা সুরক্ষায় রাসূল সা:-এর অন্যতম ও বিস্ময়কর পদক্ষেপ। রাসূল সা: মদিনার স্বাধীনতা অক্ষুণœœ রাখার জন্য ওহুদের ময়দানে তাঁর দানদান বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও আক্রমণ মোকাবেলা করে অষ্টম হিজরি মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে রাসূল সা: জালিম, সন্ত্রাসী ও পৌত্তলিকতার পাঞ্জা থেকে পবিত্র ভূমি মক্কা মুক্ত করলেন।
সামান্য সময়ের ব্যবধানে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধিকে বিস্তৃত করে সমস্ত আরব ভূখণ্ড ভরে দিয়েছিলেন শান্তি ও নিরাপত্তায়, অভূতপূর্ব শৃঙ্খলায়, সুষম বণ্টন, ভ্রাতৃত্ববোধে এবং স্বপ্নাতীত কল্যাণ। মুসলিম ইতিহাস অনুসরণে বাংলার বীর দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত আর জীবন ত্যাগের বিনিময়ে ২০০ বছরের পরাধীনতার গোলামির শিকল ভেঙে ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। লাল-সবুজের একটি পতাকা। স্বাধীনতার মর্যাদা পেয়েছি ঠিকই; কিন্তু আমরা কি পেয়েছি সত্যিকারের স্বাধীনতা? এক সাগর রক্ত, মা-বোনের ইজ্জত, এত প্রাণ ও ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্য ছিল কী? প্রত্যাশা পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে রাজনৈতিক ও নৈতিক ব্যবস্থাপনায় সার্থক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে সুখী, সমৃদ্ধশালী, শিক্ষিত ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া। ভাষা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই জাতীয় অর্জনে সুফল ভোগ করবে। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দেশবাসীর স্বপ্ন আর প্রত্যাশার রূপায়ণ প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু সেটা কেন? আমাদের কিসের অভাব? শুধু অভাব দেশপ্রেমের। রাসূল সা:-এর জীবনার্দশ ও স্বভাব চরিত্রে দেশপ্রেমের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। নিজ মাতৃভূমি মক্কা নগরীকে তিনি অধিক ভালোবাসতেন। স্বজাতি কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বিতাড়িত হয়ে জন্মভূমি থেকে মদিনায় হিজরতকালে বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকিয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘হে আমার মাতৃভূমি স্বদেশ! আমি তোমায় ছেড়ে যেতাম না’।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারা গৌরবের। রাসূল সা:-এ শিক্ষাই দিয়েছেন। অষ্টম হিজরি মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাসূল সা: যখন বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তাঁর স্বগোত্রীয় লোকেরা হেরেম শরিফে অপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। কিন্তু রাসূল সা: এমনি মুহূর্তে স্বীয় দেশবাসীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার নজির স্থাপন করেন। যারা দেশকে ভালোবাসে, দেশের মাটি ও সীমানা রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, তাদের জন্য মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে বর্ণিতÑ রাসূলে পাক সা: ইরশাদ করেন, ‘একদিন ও একরাতের সীমান্ত পাহারা ধারাবাহিকভাবে এক মাসের রোজা রাখা ও সারারাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম’। তিরমিজি শরিফের অন্য একটি হাদিসে হজরত উসমান রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:কে ইরশাদ করতে শুনেছি, (রাব্বে কারিমের পথে) ‘একদিন সীমান্ত রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকা হাজার দিনের মনজিল অতিক্রম অপেক্ষা উত্তম।’ এ ছাড়াও দেশপ্রেমকে জাহান্নামের রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করে রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, দুই ধরনের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন কখনো স্পর্শ করবে নাÑ ১. সেই চক্ষু যে চক্ষু সর্বদায় রাব্বে কারিমের ভয়ে কাঁদে; ২. যে চক্ষু রাব্বে কারিমের পথে (সীমান্ত) পাহারাদারি করে সমস্ত রাত কাটিয়ে দেয়।
দেশপ্রেম মমত্ত্ববোধ, মাতৃত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের মহান শিক্ষা দানে অনুপ্রাণীত করে স্বীয় দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে, স্বীয় মাতৃভূমিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মকৌশল উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করার প্রকৃত শিক্ষা দেয়। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতাকে গুরুত্ববহ করতে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা, দেশকে কিছু দেয়ার মনমানসিকতা তৈরি ও দেশকে ভালোবাসতে শিখা। তাহলেই ডিজিটাল সুখী-সমৃদ্ধশালী, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব।
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement